শাঁখারীবাজারে পূজার বাজারে যা পাওয়া যাচ্ছে
গলিতে ঢুকতেই নাকে এসে লাগে ধূপের সুবাস। আড়মোড়া ভেঙে সবে জাগতে শুরু করেছে শাঁখারীবাজার। তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় সাড়ে ১০টা। পুরোপুরি কর্মচঞ্চল হতে বেলা ১১টা বেজে যাবে। তারপর বেচাকেনা চলবে দিবাগত রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত।
গলির দুপাশে সারি সারি দোকান। তাতে থরে থরে সাজানো পূজার সরঞ্জাম: শাঁখা, ফুল, ধূপ, আলতা, সিঁদুর, প্রদীপ, অলংকার। সবকিছুর মধ্যেই যেন মিশে আছে উৎসবের আবহ, ধর্মীয় আচার আর শত বছরের ঐতিহ্যের ছোঁয়া।
আর আছে আসন্ন দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে নানা ব্যস্ততা। কেউ বাঁশের কাঠামো তৈরি করছে, কেউ দোকানে বসে সাজাচ্ছে পূজার সরঞ্জাম। আসছে শারদীয় দুর্গোৎসবের জন্যই যেন প্রস্তুত হচ্ছে পুরো এলাকা।
ঐতিহ্যের গলি
হৃদয়নাথ মজুমদারের লেখা থেকে জানা যায়, ‘শাঁখারী বাজারের শাঁখারীরা বাংলার হিন্দুদের সরবরাহ করতেন শাঁখা। ধনাঢ্য শাঁখারীরা শাঁখা কিনে আনতেন সিংহল থেকে। এছাড়া, সমুদ্রের যেসব অংশে পাওয়া যেত শাঁখা, সরকার সেগুলিকে লীজ দিতেন।
যাঁরা লীজ নিতেন তাঁরা জেলেদের সাহায্যে শাঁখা উঠিয়ে বিক্রি করতেন মহাজনদের কাছে। মহাজনরা আবার শাঁখা সরবরাহ করতেন ঢাকার শাঁখারীদের কাছে।’
আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার এই শাঁখারীবাজার। সরু গলির দুই পাশে সারি সারি দোকান। কয়েকজন দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এসব দোকানের ওপরেই তাঁদের বাড়ি। পূর্বপুরুষের ভিটা ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার পর দোকানগুলো ছোট হয়ে এসেছে।
শাঁখা
শাঁখারীবাজারের দোকানগুলোয় থরে থরে সাজানো থাকে ধবধবে সাদা শাঁখা। শাঁখার নকশায় দেখা যায় নানা বৈচিত্র্য। কেউ পছন্দ করেন সাধারণ, কেউবা খোঁজেন জাঁকজমকপূর্ণ শাঁখা। সোনায় বাঁধানো শাঁখাও আছে। ৩০০ টাকা জোড়া থেকে শুরু, ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার শাঁখাও পাওয়া যায়।
টিপ
সাজসজ্জার এক অন্যতম উপাদান হলো টিপ। শাঁখারীবাজারে মিলবে ছোট, বড়, মাঝারিসহ বিভিন্ন আকারের নানা রঙের টিপ। ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায় এসব টিপের পাতা।
তামা-কাঁসার তৈজসপত্র
তামা-কাঁসার তৈজসপত্রের মধ্যে রয়েছে প্লেট, গ্লাস, বাটি, কুলা, পাতিল, প্রদীপদানি, কলসি ইত্যাদি। ‘সেন ব্রাদার্স’–এর অন্যতম স্বত্বাধিকারী বরুণ ধর জানান, পূজায় কাঁসার তৈজসপত্রের বিক্রি হয় বেশি। দেড় হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় পাওয়া যায় তামা-কাঁসার এসব তৈজসপত্র।
ঘর ও মন্দির সাজানোর উপকরণ
পূজায় ঘর ও মন্দির সাজানোর বিভিন্ন ধরনের উপকরণও পাবেন। কাগজ, ফোম, কর্কশিট ও সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় এসব উপকরণ। ঘর ও মন্দির সাজানোর এসব উপকরণ যেন উৎসবের আমেজকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। এমন এক উপকরণ হলো শোলা দিয়ে বানানো ‘কদম ফুল’। শাঁখারীবাজারের দোকান ‘শঙ্খ নিকেতন’–এর স্বত্বাধিকারী সুমন নন্দী বলেন, ‘দশমী ও লক্ষ্মীপূজায় ব্যবহৃত হয় এই কদম ফুল।’
বিগ্রহের পোশাক
শাঁখারীবাজারে পাওয়া যায় প্রতিমার বিভিন্ন ধরনের পোশাক। বিগ্রহের গড়ন অনুযায়ী নানা মাপের পোশাক মিলবে। দুর্গাপূজা সামনে রেখে এসব দোকানেও বেশ বিকিকিনি হচ্ছে।
ধূপকাঠি
পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন সুবাসের ধূপকাঠির বেচাবিক্রিও চোখে পড়ার মতো। ৫০ টাকা থেকে শুরু হয়ে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম।
মাটির প্রদীপ
শাঁখারীবাজারের গলিতে ঢুকলেই চোখে পড়ে ছোট-বড় নানা আকারের মাটির প্রদীপ। দোকানিরা জানান, পূজার আগে মাটির প্রদীপের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। পূজার রাতে ঘর, মন্দির কিংবা প্যান্ডেল আলোকিত করতে ব্যবহৃত হয় এই প্রদীপ। কেউ কেউ পোড়ামাটি রঙের প্রদীপ পছন্দ করেন। অনেকে আবার কেনার পর নিজেরাই রং করে নেন। মাটির প্রদীপের দাম শুরু হয় ১০ টাকা থেকে।
সূত্র: মুনতাসীর মামুনের ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী