বনিকবাড়ির শতবর্ষী পূজা
বাড়িটির বয়স ১২৫ বছর। তবে কয়েক বছর আগে সংস্কার করা হয়েছে। দোতলা। প্রাচীন স্থাপত্যকলার ছাপ স্পষ্ট। ধামরাইয়ের রথখোলা এলাকার এ বাড়ি বনিক হাউস বা বনিকবাড়ি নামেই পরিচিত। বিখ্যাত কাঁসাশিল্পী সুকান্ত বনিকের বাড়ি এটা।
এ বাড়ির নিচতলায় কয়েকটি ঘরে কাঁসাশিল্পের নানা নিদর্শনের প্রদর্শনী কেন্দ্র আর কয়েকটিতে কাঁসার বিভিন্ন তৈজসপত্র ও শিল্পকর্ম তৈরির কারখানা। ওপর তলায় সুকান্ত বনিকেরা থাকেন।
সুকান্ত বনিক জানান, ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে এ বাড়িতে দুর্গাপূজা হচ্ছে। পঞ্চম পুরুষের পূজা চলছে। তিনি বলেন, সাত বছর ধরে পূজায় অষ্টধাতুর দুর্গাপ্রতিমা ব্যবহার করা হচ্ছে। ৫২০ কেজি ওজনের ৮ ফুট উঁচু প্রতিমাটি শুধু পূজার সময় বের করা হয়।
বাকি সময় বাক্সবন্দী থাকে। তাহলে বিসর্জন কীভাবে হয়? উত্তর জানা গেল সুকান্ত বনিকের স্ত্রী মানসী বনিকের কাছ থেকে, দর্পণ বিসর্জন দেওয়া হয়। মানে একটি আয়নায় দুর্গাপ্রতিমার প্রতিবিম্ব দেখিয়ে সেই আয়নাটা বিসর্জন দেওয়া হয় দশমীর দিনে।
মানসী বনিক নিজেও চিত্রশিল্পী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ইউনিভার্সটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা) থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। দেশে–বিদেশে বেশ কিছু প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। বনিকবাড়ির নিচতলার একটি ঘরে তাঁর স্টুডিও।
সুকান্ত বনিকের বাড়িতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য পূজার সময় এ বাড়িতে রান্নাবান্নার যে আয়োজন থাকে, তা দেখা। এই রান্নাবান্না হয় মানসী বণিকের নেতৃত্বে। ২৩ আগস্ট পূজার রান্নার কিছু পদ তৈরি করে আমাদের দেখান।
ফটোশুটের জন্য সাজানো হলো পূজা যেখানে হয়, সেই বারান্দা। মানসী বললেন, ‘মহালয়া থেকে শুধু নিরামিষ রান্না হয়। বিসর্জন অর্থাৎ দশমীর পর আবার আমিষ রান্না হয়। ব্রাহ্মণেরা পূজার ভোগ (খাবার) রান্না করেন। আমরা মানে বাড়ির বউরা নিজেদের জন্য রান্না করি। আর আশপাশের মানুষের জন্য বাবুর্চিরা রান্না করেন। বাইরের কোনো খাবার ঢুকতে দেওয়া হয় না।’
বাড়িটা সাজানো হয় পূজার সময়। আত্মীয়স্বজন প্রায় সবাই আসেন। পূজার কয়েকটা দিন বাড়ির মানুষেরা উপোস থাকেন। পূজা শেষে প্রসাদ খেয়ে উপোস ভাঙেন। পূজার দিনগুলোয় সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত এ বাড়ির দুয়ার খোলা থাকে।
আশপাশে তো বটেই, দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন। তাঁদের জন্য খাবারদাবার রান্না করেন বাবুর্চিরা। মানসী বলেন, ‘তা হাজারখানেক মানুষের রান্না তো হয়ই। অষ্টমীর দিন ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাস থেকে বিদেশিরা আসেন। তাঁরাও আমাদের পূজার খাবার খান।’
পূজার সময়ের খাবারের তালিকাও বেশ বড়। ক্ষীরের নাড়ু, নারকেলের তক্তি, চিড়ার মোয়া, মুড়ির মোয়া, খেজুরের গুড়ের মুড়কি, আখের গুড়ের মুড়কি, পায়েস, ক্ষীর, তালের বড়া ও লাড্ডু। সয়াবিনের রসা, আলু দিয়ে ছানার রসা, আলুর দম, কচুমুখির সবজি, বুটের ডাল ও মুগের ডাল।
আনারসের চাটনি, আমের চাটনি ও জলপাইয়ের চাটনি। লুচি, পোলাও, অন্ন (ভাত), খিচুড়ি, মুড়ি ও খই। পিঠাও আছে হরেক রকম—তালের পিঠা, পুলি, দুধপুলি, ক্ষীরপুলি, মালপোয়া, দুধ চিতই ও পাটিসাপটা।
সব নিরামিষ রান্নাতেই ঘি থাকে। তাই খাবারগুলোতে ঘিয়ের একটা গন্ধ পাওয়া যায়। কয়েকটি খাবারের রন্ধনপ্রণালিও বলে দিলেন মানসী বনিক।
মুখির সবজি
কালিজিরার ফোড়নে কচুমুখি ছিলে দেওয়া হয়। এরপর ভাজতে হয়। মুখিগুলো লাল লাল হয়ে এলে নামানোর আগে শর্ষেবাটা দিতে হবে।
আলুর দম
প্রথমে ছোট বা মাঝারি আলু সেদ্ধ করা হয়। তেলের মধ্যে গোটা জিরা, জিরাবাটা, ধনেগুঁড়া, মরিচ, হলুদগুঁড়া দিয়ে একসঙ্গে ভাজতে হয়। আলু আলাদাভাবে ভাজতে হবে। এরপর একসঙ্গে করে গরমমসলা ও ঘি দিয়ে নামাতে হবে।
লাবড়া
ঝিঙা, চিচিঙ্গা, পটোল, আলু, বেগুন, শিম—যত ধরনের সবজি পাওয়া যায়, সব কেটে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর পাঁচফোড়ন দিয়ে কষাতে হবে। নামানোর আগে ঘি দিতে হবে।
আনারসের চাটনি
কুচি কুচি করে আনারস কেটে ব্লেন্ড করে নিতে হবে। একটি মরিচ দিয়ে চুলায় সেগুলো জ্বাল দিতে হবে। পরিমাণমতো চিনি দিয়ে নামাতে হবে।
তালের বড়া
তালের বড়ায় শুধু তালের রসই থাকে না, সঙ্গে নারকেল আর দুধও থাকে। ঘি, ময়দা, চালের গুঁড়া, বাংলা কলাও লাগে। সবকিছু মেখে নিয়ে বড়ার আকৃতিতে ডুবো তেলে ভাজতে হবে।
এই যে পূজার এত খাবার, বনিকবাড়িতে সব পরিবেশন করতেই ব্যবহার করা হয় কাঁসা, পাথর ও ব্রোঞ্জের বাসনকোসন। ব্রোঞ্জের থালায় সাজানো হয় পূজার পুষ্পপত্র। এভাবেই খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা হয় ধামরাইয়ের বনিকবাড়ির শতবর্ষী পূজায়।