মাছ ধরার জাহাজের প্রধান বাবুর্চি এখন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, তাঁর ভিডিও হয়তো আপনিও দেখেছেন

গভীর সমুদ্রের জেলেজীবন, মাছ ধরার মুহূর্ত আর জালে পড়া বিচিত্র সব মাছ নিয়ে ভিডিও বানান শহীদ সরদার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর পেজ ও চ্যানেলে এসব ভিডিও দেখাও হয় লাখ লাখ বার। মাছ ধরার জাহাজের প্রধান বাবুর্চি কীভাবে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হলেন, তাঁর কাছে সেই গল্পই শুনেছেন সজীব মিয়া

বিচিত্র সব মাছ নিয়ে ভিডিও বানান শহীদ সরদারছবি: শহীদ সরদারের সৌজন্যে

ভোলার লালমোহনে আমাদের বাড়ি। সমুদ্রপাড়ের মানুষই বলা যায়। তারপরও ২০১৩ সালের আগে কোনো দিন গভীর সমুদ্রে যাইনি। সমুদ্রে যাওয়ার প্রথম দিনটা তাই আজও ভুলতে পারি না। ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে চট্টগ্রাম মৎস্য বন্দর থেকে জাহাজে উঠেছিলাম। পুরো পথ ঘুমাইনি। অবাক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। প্রথম যখন জাল ফেলা হলো, তাতে কী কী মাছ ওঠে দেখার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। ৪ ঘণ্টা পর তোলা হলো। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম পোয়া, লইট্টা, রূপচাঁদাসহ নানা জাতের মাছ। তারপর প্রায় এক যুগ পার হয়ে গেছে, এখনো সেই একই আগ্রহ নিয়ে সমুদ্রে যাই। জাল টেনে তোলার পর কাছে গিয়ে দেখি, কী মাছ উঠল।

এই দেখতে দেখতেই ২০২১ সালের দিকে মনে হলো আমার ভালো লাগাটা অন্যদেরও জানাই। কয়েকজন নাবিকের ভিডিও দেখে এই আগ্রহটা জন্মেছিল। তাঁরা সমুদ্রজীবনের গল্প বলতেন। আমিও শুরু করলাম। সমুদ্রে সূর্যাস্ত, আমাদের জাহাজের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ফিশিং জাহাজ বা ট্রলার, সমুদ্রে আকাশে মেঘ জমলে, জালে বড় কোনো মাছ ধরা পড়লে ভিডিও করতাম। ভিডিও করতে করতে নিজের ভালো লাগা–মন্দ লাগাও বলতাম। মোবাইল নেটওয়ার্ক পেলে এসব আবার আপলোড করতাম। শুরুতে অত কিছু বুঝতাম না। ভিডিওর সঙ্গে নানা গান যোগ করে ‘ফিশিং ভেসেল বিডি’ নামে পেজে দিতাম। এসব কপিরাইটেড গান ব্যবহারের কারণে একসময় আমার পেজ রেস্ট্রিকটেড করে দেয় ফেসবুক। মনিটাইজেশন শুরু হয়েছিল, সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।

এরপরই ‘বিডি ফিশারম্যান’ পেজটা খুলি। এই পেজেই এখন ভিডিও আপলোড করি। এখান থেকে মাসে ৪০–৫০ হাজার টাকা আয় হয়। আস্তে আস্তে ফেসবুকের অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছি।

মাছ নিয়েই কাটে জাহাজজীবন
ছবি: শহীদ সরদারের সৌজন্যে

জাহাজজীবন

জাহাজে আমরা ৪৮ জন আছি। ক্যাপ্টেনসহ ৮ কর্মকর্তা। বাকিরা নাবিক, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বাবুর্চি। আমি যেমন হেড বাবুর্চি। তবে অনেক মাছ ধরা পড়লে আমরা বাবুর্চিরাও গিয়ে কাজ করি। ছোট, মাঝারি, বড়—এই তিন ভাগে সংরক্ষণ করা হয় মাছ। ‘ফিশমাস্টার’ এগুলোর হিসাব রাখেন। তিনি জাহাজের ক্যাপ্টেনের মাধ্যমে আমাদের অফিসে জমা দেন। বন্দর থেকে আমাদের জাহাজ চলতে শুরু করলে আর থামে না। জাল ফেলা আর তোলা এর মধ্যেই চলতে থাকে। বঙ্গোপসাগরে এলিফ্যান্ট গ্রাউন্ড, কোহিনূর গ্রাউন্ড, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডসহ বেশ কিছু ফিশিং গ্রাউন্ড আছে। এসব গ্রাউন্ডে মাছ ধরি। ২০ দিনের যাত্রায় একবার ৩৮০ টন মাছ নিয়ে ফিরেছিলাম। এবার ১১ দিনের যাত্রা শেষে ২২ জুলাই ফিরেছি, মাছ পেয়েছি ১২০ টন।

মাসে চার দিন আমাদের ছুটি। তবে মাছ ধরার মৌসুমে ছুটি নিতে পারি না। সমুদ্রে যখন মাছ ধরা নিষেধ, তখন একবারে ছুটি কাটাই। এবার ৩০ দিন ছুটি কাটিয়েছি। জাহাজে আমাদের প্রত্যেকের জীবনই ব্যস্ততায় ঠাসা। ভিডিও বানানোর জন্য আলাদা সময় পাই না। পরিপাটি হওয়ার সময় পাই না। হয়তো রান্না করছি, মাছ উঠেছে, আগুন কমিয়ে দিয়ে মুঠোফোন নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে আনি।

রান্নাবান্নার ফাঁকে ফাঁকেই সময় করে ভিডিও বানান শহীদ সরদার
ছবি: শহীদ সরদারের সৌজন্যে

ঝড়ের কবলে

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ১৮ ঘণ্টার দূরে একবার মাছ ধরছি। বিকেল পাঁচটার দিকে হঠাৎ ক্যাপ্টেন এসে বললেন, ‘জালটাল উঠিয়ে ফেলো, ওয়েদার খারাপ, আমরা চট্টগ্রামে যাব।’ নাবিকেরা সবাই অবাক। সমুদ্র শান্ত, বাতাস নেই, ভ্যাপসা গরম। অনেকটা ঝিম মেরে আছে। কেমন যেন একটা আবহাওয়া। কিন্তু ঝড়টড় কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই আমরা বললাম, ‘স্যার, ওয়েদার তো ভালো আছে।’

জাহাজে ক্যাপ্টেনের কথাই শেষ কথা। জাল তুলে রওনা দিলাম। রাত ৯টায় হঠাৎ শুরু হলো ঝড়। উত্তাল হয়ে উঠল সমুদ্র। জাহাজ একবার এদিকে কাত হয় তো আরেকবার ওদিক। প্রতিবারই ডুবে যায় যায় দশা। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি শেষ। সবাই লাইফজ্যাকেট পরে ফেলি। জাহাজে আমরা নানা ধর্মের মানুষ থাকি। সবাই যার যার মতো ওপরওয়ালাকে ডাকতে থাকলাম। এভাবে পুরো রাত কেটে গেল। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি ফিরতে ফিরতে পরদিন সকাল ৯টা বেজে যায়। ২০১৮ সালের সেই ঝড়ে আমাদের মতো মাছ ধরা একটি জাহাজ সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন
এই মাছ ধরার জাহাজেই কাজ করেন শহীদ
ছবি: শহীদ সরদার

এক টানে ৫০ টন ইলিশ

 ২০১৯ সালে একবার আমরা গভীর সমুদ্র থেকে চট্টগ্রামের দিকে ফিরছি। ইনানি সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি এসে শেষবারের মতো জাল ফেলা হলো। কয়েক ঘণ্টা পর জাল তুলেই চট্টগ্রামের দিকে চলে যাবে জাহাজ। এদিকে মোবাইল নেটওয়ার্ক পেয়ে জাহাজের পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে বাড়িতে কথা বলছি। এমন সময় ব্রিজ রুম থেকে কথাবার্তা শুনলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আমাকে সিসিটিভি দেখিয়ে বললেন, কিছু দেখতে পাও? দেখলাম, মাছ লাফাচ্ছে। এ আর নতুন কি, এমন তো প্রায়ই দেখি! কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর যখন জাল তোলা হলো, তখন তো রীতিমতো ইতিহাস। মেপে দেখা গেল প্রায় ৫০ টন মাছ। সব ইলিশ! পুরো ঝাঁকটাই জালে আটকা পড়েছিল। আর কোনো দিন এত মাছ একসঙ্গে ধরা পড়তে দেখিনি। সবচেয়ে বড় মাছ দেখেছি ২০০ কেজি ওজনের। হামুর মাছ।

আমার বয়স প্রায় ৪০ বছর। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। ২০০৩ সালে পিজি হাসপাতালের (বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ডক্টরস ক্যানটিনে কাজ নিয়েছিলাম। রান্নাবান্না করতে ভালো লাগত বলে আমার সম্বন্ধী জাহাজে এই কাজের ব্যবস্থা করে দেন। তিনি নিজেও জাহাজে ভালো পদে কাজ করেন।

একজন বাবুর্চি হয়ে ভিডিও বানাই, এটা অনেকেই ভালো চোখে দেখে না। আবার ক্যাপ্টেনসহ অনেকে বাহবা দেন। তবে যে যা–ই বলুক, কাজটা আমি করতেই থাকব।

আরও পড়ুন