লোহাগড়ার রিনকী বিশ্বাস যেভাবে দূরপাল্লার দেশসেরা দৌড়বিদ হলেন
১৭তম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে চারটি সোনা জেতার পাশাপাশি তিনটি রেকর্ড গড়ে হয়েছেন সেরা নারী অ্যাথলেট। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে তাঁর খালি পায়ের দৌড় অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছে। কীভাবে দূরপাল্লার দেশসেরা দৌড়বিদ হলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অ্যাথলেট রিনকী বিশ্বাস, সেই গল্পই শোনাচ্ছেন সজীব মিয়া
সেই কাকডাকা ভোরে জাতীয় স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন রিনকী বিশ্বাস। দুপুর পর্যন্ত অনুশীলন করে রুমে ফিরেছেন। রাজধানীর শাহীনবাগে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ইউনিটে নারী অ্যাথলেটদের থাকার ব্যবস্থা। সকালের কঠিন অনুশীলনের পর এই জায়গাতেই নিজেদের চাঙা করে তুলতে বিকেলে চলে কিছু খেলা। ১ সেপ্টেম্বর বিকেলেও তা–ই করছিলেন রিনকী। বিরতি দিয়ে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎ দিতে এলেন পাশের এক ক্যাফেটেরিয়ায়। সঙ্গে তাঁর কোচ শফিকুল ইসলাম আর অ্যাথলেট প্রিয়া আক্তার।
ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে প্রিয়া প্রতিযোগী হলেও ব্যক্তিগত জীবনে রিনকীর কাছের বন্ধু। একসঙ্গেই থাকেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এই দুই অ্যাথলেট। জাতীয় অ্যাথলেটিকসে এবার দুজনই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই করেছেন। এর মধ্যে ১৫০০, ৩০০০, ৫০০০ ও ১০০০০ মিটার ইভেন্টের সবগুলোতেই সোনা জেতেন রিনকী। আর ২০২১ সালে ৩০০০ মিটারে নিজের গড়া ১০ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডের রেকর্ডটিসহ মোট তিনটি রেকর্ডও গড়েছেন।
কোচ শফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘চারটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে চারটিতেই সেরা হাওয়ার নজির জাতীয় অ্যাথলেটিকসে রিনকীই গড়ল। ওর দারুণ কামব্যাক আমাদের এত দিনের কষ্টের ফল।’
এই ফিরে আসা মানে মাঝে দুই বছর রিনকীর পদক–খরায় কেটেছে। প্রথমে করোনা ও পরে টাইফয়েড আক্রান্ত হয়ে ২০২২ ও ২০২৩ সাল তাঁর খুব বাজে কেটেছে। এ সময় কোনো পদকের দেখা পাননি। তবে দৌড় থামাননি রিনকী। কিছুটা হতাশা গ্রাস করেছে, তারপরও খেলে গেছেন তিনি। গত বছর থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, সে বছর ৩০০০ মিটারে সোনা জেতেন। এরপর শুরু হয় নিজেকে ফিরে পাওয়ার জোর প্রস্তুতি। যার ফলও পেলেন। তাই কোচের ‘কামব্যাক’ কথাটায় সায় দেন রিনকী বিশ্বাস। ২০১৯ সাল থেকে বাবার মতো এই মানুষটার তত্ত্বাবধানেই যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু এই পথে এলেন কী করে?
রিনকী নিজেই শোনালেন সেই গল্প।
দিলীপ স্যার দৌড় দিতে বললেন
নড়াইলের লোহাগড়ার কুন্দশী গ্রামে রিনকী বিশ্বাসদের বাড়ি। উপজেলা সদরের পাশের গ্রাম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে। নড়াইল তো বটেই, দেশজুড়েই খেলাধুলায় পাইলট স্কুলের নামডাক। রিনকীর অনেক বন্ধু তখনই দৌড়, ফুটবল, ভলিবলে নাম লিখিয়েছে। কেউ কেউ জাতীয় পর্যায়েও অংশ নিয়েছে। সেসব দেখে রিনকীরও ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছা হতো। গ্রামের মাঠে খেলতেনও।
২০১৮ সাল। ক্লাস সেভেনে পড়েন রিনকী। একদিন স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক দিলীপ চক্রবর্তী তাকে ডেকে বললেন, ‘দৌড় লাগা তো।’
রিনকী দৌড় দিলেন। অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর তাকে থামালেন দিলীপ চক্রবর্তী। শিক্ষকের মুখে মুগ্ধতা দেখতে পেলেন রিনকী, ‘তখন বুঝিনি, পরে জেনেছি সেটা ছিল ঢাকায় খেলতে আসার বাছাইপর্ব। কিছুদিন প্রশিক্ষণ দিয়ে এরপর আমাকে স্কুলের আরও কয়েকজনের সঙ্গে ঢাকায় নিয়ে এলেন স্যার।’
সেটা ছিল জাতীয় জুনিয়র মিট। ২০ বছরের কম বয়সীদের এই প্রতিযোগিতায় ১৫০০ মিটার দৌড়ে সোনা জেতেন রিনকী। জাতীয় স্টেডিয়ামে সোনার পদক পরে নিজের ভবিষ্যৎ হয়তো দেখেই ফেলেছিলেন। রিনকী অবশ্য বললেন, ‘পদক পেয়ে আনন্দ লাগছিল, এই যা। তখন আমি একদম ছোট না, তেমন কিছু আর মনে হয়নি।’
জুনিয়র মিট শেষে বাড়ি ফিরে গেলেন রিনকী। আবার আগের মতোই ক্লাস, খেলাধুলা। মাস কয়েক পর দিলীপ চক্রবর্তীর ডাক। রিনকীকে জানালেন, বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাঁকে পছন্দ করেছে। এই বাহিনীর অ্যাথলেট দলে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
বাবা বসন্ত বিশ্বাসকে গিয়ে আনন্দের সংবাদটা জানালেন রিনকী। মেয়ের অ্যাথলেট হওয়ার সিদ্ধান্তের ভার দিলীপ চক্রবর্তীর ওপরই দিলেন মাছ ব্যবসায়ী বসন্ত। এই শিক্ষক এলাকায় সবার শ্রদ্ধেয়। তাঁর হাত ধরে গড়ে উঠেছে লোহাগড়ার অনেক অ্যাথলেট। দিলীপ চক্রবর্তী এবারও নিজের ওপর আস্থা রাখার প্রতিদান দিলেন। রিনকীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন তিনি।
পাশে বসা শফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমরা ট্যালেন্ট হান্ট করি। রিনকীকে দেখে প্রতিভাবান মনে হয়েছিল। সে যোগ দেওয়ার পর ট্রেনিং শুরু হয়।’
অনুশীলনের ফলও পান। ২০১৯ ও ২০২০ সালে ৩০০০ মিটারে সোনা জেতেন। ২০২১ সালে সোনা জেতেন ৫০০০ মিটারে। ভারতে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান ক্রস কান্ট্রিতে অংশ নিয়ে তৃতীয় হন। এরপরই অসুস্থতার মধ্যে কেটে গেল দুঃসহ দুটি বছর।
সুদিনের স্বপ্ন
খেলায় মনোযোগ দিতে গিয়ে পড়াশোনায় এক বছর পিছিয়ে গেছেন রিনকী বিশ্বাস। তবে হাল ছেড়ে দেননি। এলাকার একটি কারিগরি কলেজে এখন এইচএসসি পড়ছেন। তাঁরা এক ভাই দুই বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, ভাইটাও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাথলেট। জাতীয় অ্যাথলেটিকসে রেকর্ড গড়া সাফল্যের পর বাড়িতে গিয়েছিলেন রিনকী। মা-বাবা তো আগে থেকেই মেয়ের সাফল্যে আনন্দিত, এবার এলাকার মানুষের মুখেও সেই আনন্দের ছটা দেখেছেন। এই ভালোবাসা নিয়েই শুরু করেছেন সাফ গেমসের প্রস্তুতি। আগামী জানুয়ারিতে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় এই প্রতিযোগিতায় নিজের সর্বোচ্চ দিয়েই লড়তে চান রিনকী বিশ্বাস। যে সুদিনের সাক্ষাৎ এবার পেয়েছেন, সেটাই এখন এই অ্যাথলেটের এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।