ঋণ থেকে মুক্তি চান? এই নিয়ম মানুন
ঋণমুক্ত জীবন মানেই স্বস্তি। অনেকেই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন। কখনো বাড়ির জন্য, কখনো ব্যবসার জন্য, আবার কখনো হঠাৎ জরুরি প্রয়োজনে। প্রথমে মনে হয়, সামান্য ঋণ, কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই সামান্য ঋণই জীবনের সবচেয়ে বড় ভারে পরিণত হয়। তাই সবার আগে দরকার ঋণ থেকে মুক্ত হওয়া। এ জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা, সচেতনতা ও নিয়মিত পদক্ষেপ। চলুন, জেনে নিই কীভাবে ঋণ থেকে সহজেই মুক্ত হওয়া যায়।
মন্দ ঋণ কেন এত ভয়ংকর
ঋণ তো ঋণই। ‘মন্দ ঋণ’ কী, আর ‘ভালো ঋণ’ই–বা কী। হ্যাঁ, ঋণ দুই প্রকার—‘ভালো ঋণ’ ও ‘মন্দ ঋণ’। মন্দ ঋণ ভয়ংকর; কারণ, এটি শুধু টাকার বোঝা নয়। এটি মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক, সব দিকেই চাপ সৃষ্টি করে। সময়মতো ঋণ শোধ করতে না পারলে দুশ্চিন্তা, ভয় আর লজ্জা বাড়তে থাকে। এতে ঘুম, মনোযোগ, এমনকি স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব পড়ে। অনেক সময় ঋণের চাপ থেকে সম্পর্ক নষ্ট হয়, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের কাছ থেকেও তৈরি হয় দূরত্ব। কেউ কেউ এই মানসিক চাপে ভেঙে পড়েন, হতাশায় ভোগেন, এমনকি আত্মহত্যার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেন। তাই মন্দ ঋণকে অবহেলা না করে যত দ্রুত সম্ভব এর সমাধান খোঁজা জরুরি।
১. সামগ্রিক চিত্রটি বোঝার চেষ্টা করুন
ঋণমুক্ত হতে হলে প্রথমেই নিজের আর্থিক অবস্থার পূর্ণ চিত্র বুঝে নিতে হবে। আপনি ঠিক কত টাকা ঋণ নিয়েছেন, কার কাছে কত দেনা আছে, কোনটিতে কত সুদ দিতে হচ্ছে, সব লিখে ফেলুন।
তারপর মাসিক আয় ও ব্যয়ের হিসাব করুন, আয় থেকে খরচ বাদ দিলে হাতে কত টাকা থাকে তা দেখুন। সেই টাকায় অন্তত প্রতিটি ঋণের ন্যূনতম কিস্তি পরিশোধ করুন এবং সম্ভব হলে কিছুটা বাড়তি দিন, এতে মোট ঋণ দ্রুত কমবে।
ক্রেডিট কার্ড ঋণ থাকলে শুধু ন্যূনতম টাকা না দিয়ে যতটা পারেন বেশি দিন; কারণ, এতে সুদের হার সবচেয়ে বেশি।
একাধিক ঋণ থাকলে আগে সেই ঋণ শোধ করুন, যেটির সুদ সর্বাধিক। ব্যাংক, এনজিও, দোকান বা আত্মীয়, যেখান থেকেই ঋণ নিয়ে থাকুন না কেন, নিয়মিত কিস্তির রেকর্ড রাখুন। এতে বাড়তি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আসবে, ফলে ধীরে ধীরে ঋণের বোঝা হালকা হবে।
২. ভালো ঋণ ও মন্দ ঋণ আলাদা করুন
সব ঋণ খারাপ নয়। যেমন ব্যবসা বাড়াতে বা বাড়ি কিনতে নেওয়া ঋণকে ‘ভালো ঋণ’ বলা যায়। কারণ, এটি ভবিষ্যতে আয় বা সম্পদ তৈরি করতে সাহায্য করে। কিন্তু ক্রেডিট কার্ড, ব্যক্তিগত ঋণ বা ভোক্তা ঋণ হলো ‘মন্দ ঋণ’। এসবের সুদ অনেক বেশি, আয় না বাড়িয়ে খরচই বাড়ায় কেবল। তাই মন্দ ঋণ দ্রুত পরিশোধ করাই প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত।
৩. আপনার সঞ্চয় ব্যবহার করুন (তবে জরুরি তহবিল নয়)
সঞ্চয়ী হিসাবে রাখা টাকায় সাধারণত ৩-৪ শতাংশ লভ্যাংশ পাওয়া যায়, কিন্তু ঋণের সুদ হতে পারে ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত। তাই অতিরিক্ত সঞ্চয় থাকলে সেটি ব্যবহার করে দ্রুত ঋণ পরিশোধ করুন। তবে জরুরি তহবিল (ইমার্জেন্সি ফান্ড) কখনো ব্যবহার করবেন না; কারণ, এটি হঠাৎ চাকরি হারানো, অসুস্থতা বা অপ্রত্যাশিত বিপদের সময়ের জন্য রাখা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
৪. খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখুন
যত দিন ঋণ আছে, নতুন কোনো অপ্রয়োজনীয় খরচের পরিকল্পনা করবেন না। চাহিদা ও ইচ্ছা—এই দুটির পার্থক্য স্পষ্ট করুন। বিলাসী খরচ বন্ধ রাখুন; যেমন নতুন গ্যাজেট কেনা, দামি পোশাক কেনা বা বাইরে খাওয়াদাওয়া। বাজেট তৈরি করুন এবং প্রতি মাসে তা মেনে চলুন।
৫. বাড়তি আয় বাড়ানোর চেষ্টা করুন
ঋণ পরিশোধের জন্য কেবল খরচ কমানোই নয়, আয় বাড়ানোও জরুরি। নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আয়ের নতুন উৎস তৈরি করুন। খণ্ডকালীন কাজ, ফ্রিল্যান্সিং, পরামর্শমূলক কাজ, রয়্যালটি (বই, সৃজনশীল কাজ ইত্যাদি), অনলাইন বা ছোট ব্যবসা। এই বাড়তি আয় সরাসরি ঋণ পরিশোধে ব্যয় করুন।
৬. পুরোনো জিনিস বিক্রি করতে পারেন
আমাদের ঘরে অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস পড়ে থাকে, যেমন পুরোনো আসবাব, ফ্রিজ, টিভি, মুঠোফোন, ল্যাপটপ, ইলেকট্রনিকস পণ্য, এমনকি জামাকাপড়ও। এসব ফেলে না রেখে বিক্রি করুন অনলাইন মার্কেটপ্লেসে। এতে একদিকে ঘর গোছানো হয়, অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে পাওয়া টাকাটা দিয়ে ঋণ পরিশোধের একটা অংশ মিটিয়ে ফেলা যায়।
৭. বাড়ির অতিরিক্ত ঘর সাবলেট দিতে পারেন
যাঁদের নিজস্ব বাসা বা ফ্ল্যাটে অতিরিক্ত ঘর আছে, তাঁরা তা ভাড়া দিতে পারেন। এতে প্রতি মাসে অতিরিক্ত কিছু আয় হবে, যা ঋণ পরিশোধে কাজে লাগানো যায়।
৮. বিনিয়োগের লাভ ব্যবহার করুন
যদি আপনার কোনো বিনিয়োগে ভালো লাভ হয়, যেমন শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড বা জমি বিক্রি থেকে, সেই লাভের একটি অংশ দিয়ে ঋণ শোধ করুন। এতে মূলধন নিরাপদ থাকে, কিন্তু আপনি সুদের বোঝা কমাতে পারেন।
৯. অপ্রয়োজনীয় ইনস্যুরেন্স বা স্কিম বাতিল করুন
লাইফ ইনস্যুরেন্স বাদে যদি অন্য কোনো বিমা বা সঞ্চয় স্কিম থাকে, সেটি ভেঙে ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করতে পারেন। কারণ, এসব স্কিমের লাভ অনেক সময় কম, কিন্তু ঋণের সুদের চাপ অনেক বেশি।
১০. উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ কাজে লাগাতে পারেন
যদি উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো জমি, সম্পদ বা অর্থ পান, সেটি এলোমেলো খরচ না করে ঋণ শোধে ব্যবহার করুন।
১১. প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে স্বল্পসুদে ঋণ নিতে পারেন
অনেক সময় অফিসের পিএফ বা প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে স্বল্পসুদে ঋণ নেওয়া যায়। যদি আপনার ঋণের সুদ অনেক বেশি হয়, তাহলে পিএফ থেকে ঋণ নিয়ে বেশি সুদের ঋণটা আগে শোধ করুন। এতে আপনি মোট সুদে অনেক সাশ্রয় পাবেন।
১২. সবচেয়ে বেশি সুদের ঋণ আগে শোধ করুন
সব ঋণ একসঙ্গে শোধ না করে, অগ্রাধিকার দিন সবচেয়ে বেশি সুদের ঋণকে। যেমন ক্রেডিট কার্ড ঋণ, পারসোনাল লোন, গাড়ির লোন, হোম লোন (এই ক্রম অনুসরণ করুন)। এতে আপনি সুদের চাপ দ্রুত কমাতে পারবেন।
১৩. পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা নিন
ঋণ মানেই ব্যর্থতা নয়; এটি শুধুই একটি আর্থিক অবস্থা, যা পরিবর্তনযোগ্য। ছোট ছোট ঋণ শোধ করুন আর নিজেকে অভিনন্দন জানান, এতে মনোবল বাড়বে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন এবং সহযোগিতা নিন। সবশেষে ঋণমুক্ত হওয়া সময়সাপেক্ষ, কিন্তু একদমই অসম্ভব নয়। ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়ে আপনি বিশাল পরিবর্তন আনতে পারেন। সূত্র: ইনট্রাম কো ইউকে, স্ট্র্যাটেজিক ফর ওয়েলথ, এক্সপেরিয়েন কো ইউকে