টেলর সুইফটের গান শুনতে শুনতে যিনি অলিম্পিক জিতেছেন
অলিম্পিকজয়ী মার্কিন ক্রীড়াবিদ এলানা মায়ার্স টেলর। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন বক্তৃতায় শুনিয়েছেন নিজের জীবনের তিনটি অনুপ্রেরণাদায়ী গল্প।
আজ থেকে ১৬ বছর আগে আমি তোমাদের জায়গায় বসে ছিলাম। তোমাদের মতো আমিও এই জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাবর্তন নিয়েছি। যত দূর মনে পড়ে, দিনটা আজকের মতোই সুন্দর ছিল। সেই দিন, বা পরে কখনো কোনো দিন ভাবিনি, জীবনে এমন কোনো সমাবর্তনে বক্তৃতা করার যোগ্য আমি হব।
আজ আমি তোমাদের তিনটি গল্প শোনাব। প্রতিটি গল্পই বিভিন্ন সময় আমার জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দিয়েছে। আর এভাবেই বাঁক বদলাতে বদলাতে আমি আজ এই বক্তৃতার মঞ্চ পর্যন্ত চলে এলাম।
প্রথম গল্প
প্রথম গল্পটা ব্যর্থতার। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সফটবল টিমের প্রথম নির্বাচিত খেলোয়াড় আমি। শুরু থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল পেশাদার খেলোয়াড় হব, ২০০৮ সালে অলিম্পিকে সফটবল খেলব। সে সময় ওটাই ছিল আমার জীবনের ধ্রুবতারা, যার দিকে তাকিয়ে আমি এগোচ্ছিলাম। কিন্তু স্বপ্ন দেখার শুরুতেই বাজেভাবে হোঁচট খাই। অলিম্পিকের দলে আমি জায়গা পাইনি। হতাশার এখানেই শেষ নয়। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো আরও একটা খবর কানে আসে। জানতে পারি, ২০০৮ সালেই অলিম্পিক গেমসে শেষবারের মতো সফটবল খেলা হবে। এর পর থেকে এই খেলা আর অলিম্পিক গেমসের অংশ থাকবে না। বুঝতেই পারছেন, আমি শুধু ব্যর্থই হইনি, ব্যর্থতার কষ্ট ঘুচিয়ে সফল হওয়ার দ্বিতীয় চেষ্টার সুযোগটাও হারিয়েছিলাম।
প্রতিযোগিতায় নেমেও নারী হওয়ার কারণে আমাকে নানা বৈষম্যমূলক কথা শুনতে হয়েছিল। কিছু কথা শোনার পরপরই আমি কানে হেডফোন গুঁজেছিলাম। নিজের মানসিক স্থিতি আর উদ্যম ধরে রাখতে টেলর সুইফটের ‘শেক ইট অফ’ (ঝেড়ে ফেলো) গানটা শুনছিলাম।
তবে ওই ব্যর্থতা আর নিয়তির নির্মম উপহাস আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছিল। ব্যর্থতা আমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। আর সেই স্বপ্নের পেছনে হেঁটেই আজ আমি তোমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পেরেছি। তাই তোমরাও আজ যখন তোমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটাকে বুকে ধারণ করে নতুন জীবনের দিকে পা বাড়াচ্ছ, মনে রেখো, এই পথে ব্যর্থতা অনিবার্য। কিন্তু তাতেই থেমে যেয়ো না। নতুন স্বপ্ন দেখা, নতুন করে শুরু করার স্পৃহা সব সময় মনে জাগ্রত রেখো।
দ্বিতীয় গল্প
গল্পটা টেলর সুইফটকে নিয়ে। ১৮০০ শতক থেকে ববস্লেডিং খেলা হয়ে আসছে। যুগের পর যুগ ধরে এই খেলার দুটো ধরন সবাই দেখেছে: ফোর-ম্যান কম্পিটিশন এবং টু-ম্যান কম্পিটিশন। ‘ম্যান’ শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এটা শুধু পুরুষদের খেলাই ছিল। খেলাটির প্রচলন হওয়ার প্রায় ১০০ বছর পর ববস্লেডিং খেলায় নারীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু সেখানেও ছিল শর্ত। নারী খেলোয়াড়েরা শুধু ছোট স্লেডের খেলায় অংশ নিতে পারবেন। অর্থাৎ সবচেয়ে বড় ‘ফোর-ম্যান কম্পিটিশন’ নারীদের জন্য নয়।
একসময় আমি অলিম্পিক গেমসে সুযোগ পেলাম এবং ছোট স্লেডের খেলায় অংশ নিয়ে দুটো অলিম্পিক মেডেলও জিতলাম। সেই সঙ্গে সব ধরনের খেলায় নারী খেলোয়াড়দের অংশ নেওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করার কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। অবশেষে ২০১৪ সালে নারী খেলোয়াড়দেরও ‘ফোর-ম্যান কম্পিটিশন’-এ অংশ নেওয়ার অনুমতি দেয় অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ। ভেবেছিলাম জিতে গেছি, ভেবেছিলাম ইতিবাচক পরিবর্তনটা বুঝি করেই ফেললাম। কিন্তু না, সামনে এসে উপস্থিত হলো নতুন প্রতিবন্ধকতা। অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের ববস্লেড প্রোগ্রামের কোনো পুরুষ খেলোয়াড়ই নারী স্লেড ড্রাইডারের পেছনে বসতে রাজি হলেন না। অথচ চারজন দক্ষ খেলোয়াড় ছাড়া আমি তো মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারব না।
যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় আমি প্রতিষ্ঠিত ববস্লেড খেলোয়াড়। অলিম্পিক মেডেলও জিতেছিলাম। এরপরও কেউ আমার দলের অংশ হতে চায়নি। মূল বিভাগে আমার খেলা নিয়ে যখন বিরাট অনিশ্চয়তা, তখন এগিয়ে আসেন একজন, নাম নিক টেলর। তিনি এখন আমার স্বামী, আমার সন্তানের বাবা এবং আমার খেলার পার্টনার। নিকই আমাকে প্রথম জানিয়েছিলেন, শুধু নারী খেলোয়াড় বলে আমার দলে যোগ দিতে চাননি কোনো পুরুষ। পরে নিকের চেষ্টায় আমি একটা দল গড়ি। মূল প্রতিযোগিতায় নেমেও নারী হওয়ার কারণে আমাকে নানা বৈষম্যমূলক কথা শুনতে হয়েছিল। কিছু কথা শোনার পরপরই আমি কানে হেডফোন গুঁজেছিলাম। নিজের মানসিক স্থিতি আর উদ্যম ধরে রাখতে টেলর সুইফটের ‘শেক ইট অফ’ (ঝেড়ে ফেলো) গানটা শুনছিলাম। এই গান শুনতে শুনতেই অলিম্পিক মেডেল জিতে ইউএস মেনস ন্যাশনাল টিমের প্রথম বিজয়ী নারী হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখাই।
অর্থাৎ আজকের পর থেকে মনে রেখো, জীবনের লক্ষ্যগুলো তোমাকে এমন অনেক জায়গাতেই নিয়ে যাবে, যেখানে শুধু প্রতিবন্ধকতা, ঘৃণা আর বৈষম্য থাকবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে টেলর সুইফটের ‘শেক ইট অফ’ শোনো, এবং সত্যি সত্যিই নিন্দুকের নিন্দা, বৈষম্যমূলক মন্তব্য আর ব্যর্থতাকে ঝেড়ে ফেলো, এগিয়ে যাও।
তৃতীয় গল্প
এটা বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া আর নিয়ন্ত্রণের গল্প। ঘটনাটা এই তো মাত্র কয়েক মাস আগের। ২৯ জানুয়ারি, চীনের বেইজিংয়ে পৌঁছানোর দুই দিনের মাথায় আমার স্বামী নিক ও আমার বাবা—দুজনেরই কোভিড ধরা পড়ে। নিক আমার কোচ ও ইউএস মেনস ববস্লেড টিমের সদস্য। আর বাবা আমার এক বছর বয়সী ছেলের দেখভালের জন্য আমার সফরসঙ্গী হিসেবে বেইজিংয়ে গিয়েছিলেন। আমরা সবাই টিকা নিয়েছি, বুস্টার ডোজও। এরপরও আমার দুই সফরসঙ্গী কোভিডে আক্রান্ত হলেন। একদিকে আমার পরিবারের কোভিড–সংগ্রাম, অন্যদিকে বেইজিং অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার চার বছরের স্বপ্ন, পরিশ্রম আর অধ্যবসায়। আমার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। প্রথমটি হলো পরিবারের সঙ্গে থেকে নিজেকেও কোভিডের হাতে সঁপে দেওয়া এবং অলিম্পিকে অংশ না নিয়েই দেশে ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়টি হলো, ৯ দিন নিজের সন্তান, বাবা ও স্বামীর কাছ থেকে নিজেকে দূরে রেখে, হোটেলকক্ষে বন্দী থেকে অলিম্পিকের স্বপ্ন পূরণ করা। আমি দ্বিতীয়টি বেছে নিলাম।
কী যে মানসিক পীড়নের মধ্য দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে, আজকের দিনে এসে তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না। ওই দিনগুলোয় আমার ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য বুকের দুধ ছোট ছোট বোতলে ভরে হোটেলের এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে কত কায়দা করে যে পাঠাতাম! ছোট্ট একটা হোটেলকক্ষে আমি অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি নিতাম, ব্যায়াম করতাম। এত অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তার মধ্যেও উদ্যম ধরে রাখতে হতো। কীভাবে রাখতাম? পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমি একটা তালিকা বানিয়েছিলাম সে সময়। নিজে কী নিয়ন্ত্রণ করতে পারব আর কী পারব না। যেসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা আমার ক্ষমতার বাইরে, সেসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করে শক্তি অপচয় করতাম না। যা আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেগুলোতে নিজের পুরোটা উজাড় করে দিতাম। এ জন্যই তো এত কিছুর পরও শেষহাসিটা হাসতে পেরেছিলাম। বেইজিং অলিম্পিকে মেডেল জিতেছিলাম। আর এই জয় আমাকে উইন্টার অলিম্পিক গেমস ইতিহাসে সর্বাধিক পদকজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি এনে দেয়। এই সবই পেয়েছি ব্যর্থতার কারণে। ব্যর্থতাই আমাকে জেতার তাগিদ দিয়েছিল।
তাই তোমাদেরও বলতে চাই, যা তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সবটুকু মনোযোগ আর চেষ্টা সেদিকেই দাও। দেখবে সংকট আর সংগ্রামগুলো সহজেই উতরে গেছ।
সূত্র: জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ইউটিউব চ্যানেল