ভাতের আঠা আর ডিমের সাদা অংশে তৈরি হয়েছিল চীনের মহাপ্রাচীর?

চীনের মহাপ্রাচীর হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এক বিষ্ময়ের নামছবি: রয়টার্স

অনেকের মতো আমিও স্কুলের সাধারণ জ্ঞানের বই থেকে মহাপ্রাচীরের কথা জেনেছিলাম। অবশেষে ঘুরে এলাম সেই মহাপ্রাচীরের দেশ। প্রাচীরটি নিয়ে মাও সে–তুং একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘একজন ব্যক্তি কখনো প্রকৃত বীর হয়ে উঠতে পারে না, যদি না সে কোনো দিন মহাপ্রাচীরের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছায়।’ নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এমন নিদর্শন নিজ চোখে না দেখলে চীনের জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম কীভাবে জাগ্রত হবে? সে জন্যই এমন কবিতা রচনা। অবশ্য প্রকৃত বীর হওয়ার জন্য নয়, মানুষের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি, সপ্তাশ্চর্যের একটি ও চীনের দর্শনীয় কিছু স্থান ভ্রমণের জন্য জীবনকে কিছুটা সুযোগ করে দিলাম। সেসব অভিজ্ঞতারই সামান্য কিছু অংশ আজ বলব।

প্রাচীর দেখার দিন

বেইজিংয়ে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, একসময় এ জায়গা ঘিরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন এক নগরী। এখানকার সড়কগুলো বেশ প্রশস্ত। ইলেকট্রিক বাইক চালকের সংখ্যা প্রচুর। নারী, পুরুষ, ডেলিভারিম্যানদের প্রধান পছন্দ এই যান। চীনের রাস্তায় কোনো শব্দদূষণ নেই। যদিও আমাদের উবার ড্রাইভারকে দেখলাম দু–একবার হর্ন বাজাতে। আমরা তো অবাক, একি কাণ্ড! চীনেও সুযোগ পেলে কেউ কেউ নিয়ম ভেঙে ফেলতে চায়। তাই ট্রাফিক সিগন্যালের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশও রয়েছে। যদিও সবাই বেশ ভালোভাবেই নিয়ম মেনে চলে। নইলে জরিমানা। চীনে প্রকাশ্যে ধূমপানের দৃশ্য দেখে প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিলাম। পরে জানলাম, ইনডোরে নিষিদ্ধ হলেও আউটডোরে এখানে ধূমপান করা যায়। ধূমপায়ীর সংখ্যাও প্রচুর; যেখানে–সেখানে সিগারেটের অবশিষ্ট ফেলে যায়। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা খুব দ্রুত সেসব পরিষ্কার করে ফেললেও ব্যাপারটা বিরক্তিকর মনে হয়েছে। এমন ঝকঝকে, দূষণমুক্ত শহরে ধূমপায়ী দেখব, কল্পনাও করতে পারিনি।

বেইজিংয়ে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, একসময় এ জায়গা ঘিরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন এক নগরী
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ফেব্রুয়ারির শেষেও বেইজিং বেশ ঠান্ডা। গাছগুলো একদম পাতাহীন। এ কারণে পাখির বাসাগুলো নজর কাড়ছিল বারবার।
মহাপ্রাচীর দেখতে যাওয়ার দিনটিতে মনের ভেতর বেশ উত্তেজনা বোধ করলাম। এই প্রাচীর দেখার জন্যই তো এখানে আসা! সকাল–সকাল রওনা দিলাম। মুটিয়ানয়ু নামের একটা জায়গায় পৌঁছাতে গাড়িতে সময় লাগল দুই ঘণ্টা। সড়কের পাশের লেকে দেখি, বরফ জমে আছে। তবে যতটা ভয় পেয়েছিলাম, শীত ততটা নয়। রোদ উঠে গেছে। এবার কেব্‌ল কারে করে পাহাড়ের ওপর ওঠার পালা।
ওপরে উঠতে উঠতেই দেয়ালটা চোখে পড়ে। পাহাড় এখন ধূসর হয়ে থাকলেও বছরের অন্য সময়ে একদম সবুজ, কখনো আবার বরফেও ঢাকা থাকে। কিছু গাছে গোলাপি চেরি ফুটে আছে।

প্রাচীরটা দেখতে দেখতে জানলাম, আঠালো ভাত ও ডিমের সাদা অংশের মিশ্রণ দিয়ে ইটের পর ইট জুড়ে এটি তৈরি! শুনে তো বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলাম। না জানি ৮ হাজার ৮৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ দেয়ালে ইট জোড়া দিতে কত ভাত ও ডিম জোগাড় করতে হয়েছিল।

সেই সময়ের খাদ্য ও সম্পদে সমৃদ্ধ চীনকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। সত্যিই মিং সম্রাটদের বিস্ময়কর নিদর্শন এই মহাপ্রাচীর!

আরও পড়ুন

এত উঁচুতে বেওয়ারিশ বিড়াল!

মহাপ্রাচীরে কিছু বেওয়ারিশ বিড়ালকে নিশ্চিন্ত মনে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

প্রাচীরের একটা জায়গায় গিয়ে কেব্‌ল কার আমাদের নামিয়ে দিল। গাইড সময় বেঁধে দিল এক ঘণ্টা। এর মধ্যে প্রাচীরের শীর্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়। মাও সে–তুংয়ের সেই ‘প্রকৃত বীর’ হওয়া যে চাট্টিখানি কথা নয়, সেটা বুঝলাম।

তবু দেখা যাক, কত দূর যেতে পারি। লক্ষ করলাম, পাহাড়ে চীনা ভাষায় লেখা, ‘আমরা মাওয়ের প্রতি অনুগত।’
মহাপ্রাচীরে কিছু বেওয়ারিশ বিড়ালকে নিশ্চিন্ত মনে ঘোরাফেরা করতে দেখলাম। এমনিতে চীনের মহাসড়কে কিন্তু কোনো বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়াল নেই। এত উঁচু জায়গায় মানুষেরই উঠতে কষ্ট হয়, সেখানে ওরা যে কেন যায়, কে জানে।

আমরা নাহয় কেব্‌ল কারে করে গিয়েছি, ওরা কীভাবে গেল? শুনলাম, পাহাড়ি ইঁদুরের কারণে দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ইঁদুর শিকারের জন্য এখানে বিড়াল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঘুরতে এসে পর্যটকেরা আবার বিড়ালদের খাবার দিয়ে যাচ্ছে। ওরা কিছু খায়, কিছু খায় না।
প্রাচীর ধরে ওপরে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম, শুধু ঘুরতে এসেই আমরা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, আর এখানে শ্রমিকেরা কাজ করতেন। কোনো ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই উঁচু পাহাড়ের ওপর ভারী ভারী পাথর, ইট দিয়ে এত দীর্ঘ দেয়াল নির্মাণ করা কি চাট্টিখানি কথা!

শুধু জোর খাটিয়ে কিংবা অত্যাচার করে এমন বিস্ময়কর দেয়াল নির্মাণ সম্ভব নয়। এ রজন্য কর্মীদের মনে দেশের প্রতি কী ধরনের আবেগ–অনুভূতি দরকার হয় বুঝুন। মিং সম্রাটের প্রতি আনুগত্যের অথবা ধর্মীয় মোটিভেশন দেওয়া হয়েছিল কি না, জানা নেই। চীনের পুরোনো একটি বাগ্‌ধারা আছে, ‘অনেক ইচ্ছা মিলে একটি দেয়াল।’

আরও পড়ুন

দেয়াল নিয়ে মিথ

এই দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে বহু মানুষের কান্না
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এই দেয়াল নির্মাণ করতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রমে, বিরূপ আবহাওয়ায় দুর্ঘটনা, উঁচু স্থান থেকে পড়ে, পাথর চাপায়, রোগে ভুগে কত শ্রমিকেরই না মৃত্যুও হয়েছিল। তাই এ দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে বহু মানুষের কান্না।

সেই কান্না নিয়েও রয়েছে মিথ, রয়েছে কাব্য ‘মহাপ্রাচীর তৈরিতে হাজারও শ্রমিক কষ্ট করেছে, এক মেং জিয়াংয়ের কান্নায় কী এসে যায়!’
মিথ রয়েছে, মেং জিয়াং নামের এক তরুণীর সঙ্গে এক যুবকের বিয়ে হয়। তারা পরস্পরকে ভীষণ ভালোবাসত। কিন্তু মিং সম্রাটের নিয়ম অনুযায়ী গ্রামের সব সক্ষম যুবককে বাধ্যতামূলকভাবে মহাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ করতে হতো। তাই মেং জিয়াংয়ের স্বামীকে চলে যেতে হয় প্রাচীর নির্মাণের কাজে।

একসময় সে পাথরচাপা পড়ে মারা যায়। দীর্ঘ বিরহের পর নিজ হাতে বোনা গরম কাপড় নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যায় মেং জিয়াং। কিন্তু নির্মাণাধীন প্রাচীরের মাঝে সে খুঁজে পায় স্বামীর মরদেহ। মেং জিয়াংয়ের কান্নায় প্রাচীরের কিছু অংশ তখনই ভেঙে পড়ে।
শুধু মানুষের কান্নাতেই নয়, দেয়ালের অনেক অংশই রোদ, ঝড়বৃষ্টি, ভূমিকম্প, তুষারপাত ইত্যাদি নানা কারণে ধংসপ্রাপ্ত হয়েছে। অবশ্য চীন সরকার সেসব সংস্কারও করেছে।

মহাপ্রাচীরের দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে তিন হাজার বছর আগের সেই সময়কে, কর্মীদের অনুভূতিকে অনুভব করার চেষ্টা করতে করতেই এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। এবার ফেরার পালা। সত্যি, এ প্রাচীর বিস্ময়কর। এখানে না এলে দেয়ালের মাঝে মানুষের বিস্ময়কর শক্তির কথা হয়তো এভাবে অনুভব করতে পারতাম না।

ই–মেইল: [email protected]

আরও পড়ুন