স্মৃতিমেদুর থামেল থেকে রূপময় পোখারা
নেপালের পোখারা থেকে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প—সব মিলিয়ে ১০ দিনের ট্রেক। পথটা দুর্গম, তবে অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। হিমালয়ের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ভুলিয়ে রাখে গন্তব্যে পৌঁছার কষ্ট। যেতে যেতে আরও কত কি যে চাক্ষুষ হয়! মে মাসে পার্বত্য এই পথেই হেঁটে এসেছেন ইফতেখারুল ইসলাম। সেই অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব
অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প ট্রেকের প্রায় প্রতিটি জায়গা থেকে ফিশটেইল বা মচ্ছপুছারে পর্বতশিখরের অসামান্য সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। একেক জায়গা থেকে এর একেক রূপ। আবার দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম আলোতেও বদলায় এর রূপ। ছমরং থেকে সূর্যাস্তের সময় দেখা মচ্ছপুছারে চিরদিন মনে রাখার মতো একটা দৃশ্য। মার্চ বা অক্টোবরে সেটা সত্যিই স্মরণীয়। আমি মে মাসে ঘানড্রুক বা ছমরং থেকে সূর্যাস্তের সময় মচ্ছপুছারের সবচেয়ে অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাইনি। কারণ, প্রতিদিন বিকেলে আকাশে মেঘ জমে, কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়। সূর্যাস্তের আগে বৃষ্টি থেমে যায়। তখন মেঘ সরে গেলেও অস্তগামী সূর্যের আলো ঠিক স্বাভাবিকভাবে পর্বত শিখরের গায়ে পড়ে না।
তা ছাড়া এই অন্নপূর্ণা অঞ্চলের সব পাহাড়েই সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত আলোর রশ্মি ছড়িয়ে যে বর্ণিল শোভা তৈরি করে, শরত্কালেই তা বেশি সোনালি হয়। গাইড তেজের মুখে এ কথা শুনে আমার মনে পড়ল মচ্ছপুছারে প্রথম দেখার স্মৃতি। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে পোখারার সারংকোট এলাকা থেকে দেখা সূর্যোদয়ের দৃশ্য। তখন বিন্দু বিন্দু তরল সোনা গলে পড়ছিল মচ্ছপুছারে আর অন্নপূর্ণার অন্যান্য শিখরের চূড়ায়। অনেক দূর থেকে দেখেও সে দৃশ্যে আমরা মোহিত হয়েছিলাম। সেদিনই পাহাড়ের আরও কাছে যাওয়ার ইচ্ছা জেগেছিল আমার মনে। আর একবার সূর্যোদয়ের ওই তরল স্বর্ণ দিয়ে অন্নপূর্ণার পর্বতশিখরে অনেকগুলো মুকুট তৈরি হতে দেখেছিলাম গত বছরের শরৎকালে মানার থেকে।
ঘানড্রুক বা ছমরংয়ের কথা লেখার আগে কাঠমান্ডু যাওয়া এবং ট্রেক শুরুর সময়কার কথাগুলো বলে নেওয়া দরকার। ঢাকায় ২ মে ভোরবেলা একটু অনিশ্চয়তার বোধ নিয়ে এয়ারপোর্টে যাই। ঈদ হয়ে গেছে এক সপ্তাহ। এখনো এয়ারপোর্টে একেবারেই ভিড় নেই। বিমান ঠিকমতো যাবে তো? বাংলাদেশ বিমান এত নিয়মিত ও সময়মতো কাঠমান্ডুর ফ্লাইট অপারেট করে! একটু অবাকই হই। সেদিনও সময়মতো বোর্ডিং শেষ হয়। তারপর রানওয়ের মুখে গিয়ে ওড়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ আটকে থাকতে হয় টেক-অফের লাইনে। অন্য কয়েকটা বিমানের পেছনে ছিলাম বলে সামান্য দেরিতে উড়ে ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে গিয়ে অবতরণ করি আমরা।
কাঠমান্ডুতে ইমিগ্রেশনে অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিতে এবার সময় লাগে কম। কারণ, ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ানোর আগে একটা কিয়স্কে গিয়ে যে ফরম পূরণ করতে হয়, তা আমি ঢাকা এয়ারপোর্টে বসে বসে মুঠোফোনের সাহায্যে অনলাইনে করে ফেলেছি। সেই নিবন্ধনের একটা স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছি। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাকে সেটা দেখিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে ভিসা পেয়ে যাই। এরপর অবশ্য লাগেজের জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়। স্যুটকেস নিয়ে বাইরে বেরিয়েই আমার ট্রেকিং এজেন্সি থেকে আসা গাইড তেজের সঙ্গে দেখা। ওকে দেখলেই প্রত্যেকবার আমি বালকের মতো খুশি হয়ে উঠি। ওর দেওয়া গাঁদা ফুলের মালা নিয়ে কুশল বিনিময় করতে করতে গাড়িতে উঠি। পরিচিত পথ ধরে কিছুক্ষণের মধ্যে থামেলে পৌঁছে যাই।
২০২০ সালে ইবিসি ট্রেক সেরে এসে কোভিড লকডাউনে যে হোটেলে আটকে ছিলাম বেশ কিছুদিন, এবারও সেখানেই থাকছি। শুধু তো আটকে থাকা নয়, মহামারি, লকডাউন, বিমান চলাচল বন্ধ আর সার্বিক অনিশ্চয়তা। কী এক অদ্ভুত সময়ই না কেটেছে। হোটেল ফেয়ারফিল্ড বাই ম্যারিয়ট। সারা জীবন নানা কাজে কত দেশে কত হোটেলে থেকেছি। তাদের ভালো–মন্দ কোনো কিছুই দুই দিনের বেশি মনে রাখিনি। কোথাও আমার কোনো আবেগ জন্ম নেয়নি। অথচ এই ফেয়ারফিল্ড ম্যারিয়ট অন্য রকম আপন লাগে, বড় বেশি মায়াময় লাগে। সেবার দেশে ফেরাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। সংক্রমণের ভয়ে হোটেলের বাইরে কোথাও পা বাড়ানোর অনুমতি ছিল না। হোটেলে বসেই দেশে ফেরার উপায় নিয়ে ফোনে ও ই–মেইলে নানাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।
দু-একজন বাদে এ হোটেলের পুরোনো কর্মীদের কেউ এখন নেই। অন্য কেউ ওই সময়টাকে মনে রাখেননি। তাঁরা আমার স্মৃতি ও আবেগ বুঝতে পারেন না। সেবার প্রতিদিনের ২৪ ঘণ্টা কেটেছিল হোটেলের ঘরে, লবিতে ও রেস্তোরাঁর ভেতরে। লবির বাইরে যে প্যাসেজে আমরা হাঁটতাম, সেখানে এখন একটা জাপানি রেস্তোরাঁ ও বার তৈরি হয়েছে। আমি তার এক প্রান্তে চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি।
ঢাকার তীব্র দাবদাহ থেকে কাঠমান্ডুতে এসে শরীর মন দুই–ই শীতল হয়। তাই বলে এই মধ্য বৈশাখে এত শীত? মুঠোফোনে আবহাওয়া দেখি। ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার ওপর এখনই বৃষ্টি নামবে। আমি ওপরে গিয়ে জ্যাকেট গায়ে দিয়ে নেমে আসি। ফেয়ারফিল্ড ম্যারিয়ট থেকে বেরিয়ে রাস্তার অপর পাশে হোটেল ব্লু হরাইজনের লবিতে গিয়ে সন্তোষের সঙ্গে কথা বলি। কাল সকালে বা দুপুরের ফ্লাইটে পোখারা যাওয়া হবে। পরশু ভোরে গাড়িতে করে নয়াপুল গিয়ে সেখান থেকে শুরু করব আমার ১০ দিনের ট্রেক। কোন পথ দিয়ে কবে কোথায় যাওয়া হবে, কীভাবে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে পৌঁছাব আর কীভাবে ফিরে আসব তার বিস্তারিত কার্যক্রম ও মানচিত্র আমাকে বুঝিয়ে দেয় সন্তোষ। অন্নপূর্ণা কনজারভেশন এরিয়া প্রজেক্ট এলাকায় প্রবেশ ও ট্রেকিংয়ের জন্য তেজ আমার পারমিট নিয়ে এসেছে।
আসলে এবার আমার জন্য থাকার কথা ছিল অন্য একজন গাইড। তেজকে আমার সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার কথা ছিল না। কয়েক দিন আগে তিনজন মালয়েশিয়ান নারী ট্রেকার নিয়ে তেজের চলে যাওয়ার কথা ছিল অন্নপূর্ণা সার্কিটে। তাঁদের একজন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওই দলটি তাঁদের ট্রেক পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে শেষাবধি তেজ আমার দায়িত্ব পেয়ে যায় আগের মতো।
সন্তোষের ধারণা আমি ইবিসি, গোকিও, থোরাং লা পাস ইত্যাদি ট্রেক করে এত অভিজ্ঞ ট্রেকার হয়ে উঠেছি যে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প আমার জন্য মোটেই কঠিন কিছু হবে না। আমি তাকে বারবার বলি যে এই পথে অনেক খাঁড়া, চড়াই–উতরাই আছে। সেগুলোতে আমার খুব কষ্ট হয়। আমার বয়সের কথা ওদের মনে করিয়ে দিয়ে লাভ নেই। ওরা ধরেই নিয়েছে পাহাড়ের কাছে যাওয়ার জন্য আমি বয়সের বাধা অগ্রাহ্য করে পথ চলতে পারব। মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয় এরা আমাকে দিয়ে এসব ট্রেক করিয়ে প্রমাণ করতে চায় ‘এই বয়সেও’ সম্ভব।
এ কথা ঠিক যে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প অঞ্চলের অলটিচুড বা উচ্চতা তুলনামূলকভাবে কম বলে শ্বাসকষ্ট বা অবসাদ কম হওয়ার কথা। এভারেস্ট বেজক্যাম্পে যাওয়ার সময় এর চেয়ে অনেক বেশি উঁচুতে বেশ কয়েকটা দিন ট্রেক করে চলতে হয়।
এবার পোখারা যাওয়ার জন্য একটা নতুন এয়ারলাইনসের টিকিট কাটা হয়েছিল। শ্রী এয়ারলাইনস। ৩ তারিখ ভোরে ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের ডোমেস্টিক টার্মিনালে গিয়ে দেখি সেই ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। সম্ভবত ওদের যাত্রী কম। এদের চেক-ইন ডেস্ক বন্ধ। সেখানে কারও মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে না। তেজ ভেতরে গিয়ে ওদের অফিসে যোগাযোগ করে আমার টিকিট বদলে ইয়েতি এয়ারলাইনসের টিকিট নিয়ে আসে। তারপর যথারীতি চেক-ইন।
কয়েক মাস আগে পোখারার কাছেই যে ইয়েতি এয়ারলাইনসের বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল, সে কথা মনে পড়ল। মাত্র ২৫ মিনিটের ফ্লাইট। তবু একটা উদ্বেগ তো থাকেই। বিশেষ করে বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে অপেক্ষা করা আর ধীরে ধীরে গিয়ে ছোট্ট বিমানটিতে ওঠা পর্যন্ত দুর্ঘটনার কথাটা ভুলতে পারিনি। ইয়েতির ফ্লাইট খুবই মসৃণভাবে উড়ে চলে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করি আসন্ন অভিযাত্রার রোমাঞ্চটুকু উপভোগ করতে। প্লেন পোখারার বিমানবন্দর ছোঁয়ার পর হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। আর মুগ্ধ হলাম পোখারার নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনটি দেখে। সুন্দর ডিজাইনের ভবন। ভেতরের সবকিছু পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এখনো আসতে শুরু করেনি।