জীবনের প্রথম তাঁবুবাস করলাম আফ্রিকার অরণ্যে

আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে উঁচু পর্বত কিলিমানজারোতে গিয়েছিলেন ইফতেখারুল ইসলাম। পর্বত আরোহণ ছাড়াও তানজানিয়ায় জাতীয় উদ্যানে সাফারি করেছেন তিনি। এ সফরের গল্প নিয়েই আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ পড়ুন চতুর্থ কিস্তি।

গাছের ছায়ায় প্রথম দিনের ক্যাম্পছবি: ইফতেখারুল ইসলামের সৌজন্যে

পরদিন সকালে হোটেল থেকে ২১ জনের চেকআউট, সবার একটা করে স্যুটকেস হোটেলে রেখে যাওয়া, আর সবার ডাফেল ব্যাগ গাড়িতে ওঠানো একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়ে দাঁড়ায়। হোটেলের রিসেপশনের দায়িত্বে থাকা দুই নারীকে দিশেহারা দেখায়। গাইডরা এ কাজেও আমাদের সহায়তা করে।

আগের রাতের মিটিংয়ের পর থেকে শুরু করে পরের দিনগুলোয়, ট্রেকজুড়ে এই গাইড দল আমাদের পথ দেখিয়েছে। সব রকম যত্ন নিয়েছে, সহায়তা দিয়েছে। সারাক্ষণ বলেছে, ‘জাম্বো জাম্বো’, ‘পোলে পোলে’ আর ‘হাকুনা মাতাতা’ (হ্যালো হ্যালো, ধীরে চলো, কোনো সমস্যা নেই)। ওরাই সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছে পথের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করে আমাদের সবাইকে উজ্জীবিত রাখতে।

জিনিসপত্র ওঠানো হয়ে যাওয়ার পর ২৯ জুলাই সকালে মোশির হোটেল থেকে বাসে করে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। পথে ওদের প্রয়োজনীয় জিনিস নেওয়ার জন্য দু–একটা জায়গায় থামতে হলো। বাসে কিলিমানজারো জাতীয় উদ্যানের গেটে যেতে আমাদের লাগল আড়াই ঘণ্টা। আমরা লেমোশো রুটে যাত্রা শুরু করব। সবচেয়ে লম্বা রুট হলেও এই রুটে এক্লাইমেটাইজেশন ভালো হয় বলে পর্বতারোহণে সাফল্যের হারও বেশি। ৫ হাজার ৮৯৫ মিটার উচ্চতার কিলিমানজারো মূলত একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি এবং আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। এটা একলা দাঁড়ানো কোনো পর্বতমালার অংশ নয়। কিলিমানজারোর তিনটি আগ্নেয়গিরিসদৃশ শিখর রয়েছে—কিবো, মাওয়েনজি ও শিরা। এদের মধ্যে কিবো সর্বোচ্চ। আমরা এই কিবোতেই যাব।

কিলিমানজারো অভিযানে প্রথম দিনের ট্রেকে
ছবি: অণু তারেক

বিরিয়ানি খেয়ে যাত্রা শুরু

দুপুরে বাস থেকে নামার পর বিরিয়ানি খাওয়া হবে। তারপর লেমোশো গেট দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। এ বিশেষ ভোজ নিয়ে দলের অনেকেই বেশ উত্সাহী। বিরিয়ানি আমারও খুবই প্রিয়। সে কারণেই যত্রতত্র বিরিয়ানি খেতে আগ্রহ বোধ করি না। তানজানিয়াতে গিয়ে তো নয়ই। তবে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি, পুরো যাত্রাপথে যখন যে খাবারই দেওয়া হোক, কিছুটা খেতে চেষ্টা করব। প্রশংসা করব। কোনো খাবার নিয়ে সমালোচনা বা বিরূপ মন্তব্য করব না।

শহর ছাড়িয়ে রেইন ফরেস্টে পৌঁছে গেলাম। এন্ট্রি পয়েন্ট বা গেট থেকে যাত্রা শুরু করার আগে ছোট একটা অফিস ঘরে গিয়ে সবাইকেই নাম, পাসপোর্ট নম্বর, ফোন নম্বরসহ প্রয়োজনীয় তথ্য খাতায় লিখে দিতে হয়। এর আগেই পোর্টারদের জিনিসপত্র ওজন করে দেখা হয়। প্রত্যেকের জন্য সর্বোচ্চ সীমা ১৫ কেজি। আর নিজ নিজ ব্যাকপ্যাকে নেওয়া যায় সাত কেজি পর্যন্ত।

তানজানিয়ার মানুষগুলোকে বেশ সরল মনে হয়। হয়তো সরল বলেই নিজেদের নিয়মকানুন কঠোরভাবে পালন করে। ওদের কাজের নিজস্ব ধারা আছে। কাজ শেষ করতে সময় লাগে। কোনো কিছুতে দেরি হলেও অস্থির হওয়া যায় না। ওদের কোনো কাজে তাড়া দেওয়া যায় না। কিছু জিগ্যেস করলেই ওরা বলে ‘পোলে পোলে’, মানে ধীরে ধীরে। শুধু ভোরে সময়মতো যাত্রা শুরু করতে হবে। অন্য সব কিছুই ‘পোলে পোলে’। আর আছে তাদের অমর বাণী, ‘হাকুনা মাতাতা’, মানে কোনো সমস্যা নেই।

আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে যার যার বোতলে ও ব্যাকপ্যাকে পর্যাপ্ত পানি নিয়ে যাত্রা শুরু করি। প্রথমেই কিলিমানজারো জাতীয় উদ্যানের প্রবেশদ্বার। সবাই গেটের কাছে গিয়ে ছবি তোলার জন্য দাঁড়াই। এই জায়গা সমুদ্রতল থেকে ১ হাজার ৮৩০ মিটার উঁচুতে। ছবি তুলে একসঙ্গে যাত্রা শুরু করতেই বেলা তিনটা পেরিয়ে গেল।

কলোবাস নামের এই বিশেষ প্রজাতির বানর আছে শুধু পূর্ব আফ্রিকাতেই
ছবি: অণু তারেক

কিছু দূর যেতেই বনের গন্ধ নাকে এসে লাগে। বুড়ো গাছের গায়ে কোথাও অর্কিড, আবার কোথাও লাইকেন নামের পরগাছা ঝুলে আছে। মাঝখান দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ চলে গেছে। দুই ধারে বন। পথের পাশে শেওলার রং ও রূপ যে কত দর্শনীয় হতে পারে তা ওখানে না গেলে দেখা হতো না। একরকম গাছ খুব লম্বা। তার নামটাও গাছের মতোই বড়। বুনো ডুমুর আর বুনো জলপাই গাছে আছে প্রচুর। আমাদের সবার সামনে আছে গাইড হাওয়া। ওর পেছনে আমরা সার বেঁধে হাঁটি। মাঝখানে আরও একজন গাইড। দলের মধ্যে যাঁরা একটু ধীরে হাঁটতে চান, তাঁদের সঙ্গেও অন্য একজন গাইড আছে।

বড় বড় গাছের নিচ দিয়ে পথ চলার সময় নিজেরা একটু কম কথা বললে অরণ্যের আবহ টের পাওয়া যায়। কত যে পাখির ডাক শোনা যায়, তার হিসাব নেই। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ পাখিপ্রেমী। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য। তাঁরা সেসব পাখির নাম জানেন। রং ও বৈশিষ্ট্য চেনেন। অল্প কিছুটা এগিয়েই একটা গাছের উঁচু ডালে কলোবাস বানর দেখতে পাই। প্রথমে একটা, তারপর একটা গাছে দুটি। আর একটু পরে দেখি, বেশ কয়েকটা কলোবাস বানর গাছের উঁচু ডালে বসে পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলছে। সাদা-কালো রঙের এই বিশেষ প্রজাতির বাঁদর আছে শুধু পূর্ব আফ্রিকাতেই। লেজটা বেশ মোটা, সাদা ফারের মতো।

ঠান্ডায় কম্পমান সবাই

কীভাবে যে প্রথম দিনের বিকেলে তিন ঘণ্টা ট্রেক করে ছয় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে গেলাম, তা টেরই পাইনি। একবারও প্রশ্ন করিনি, আর কত দূর যেতে হবে। আমাদের প্রথম দিনের ক্যাম্পে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। হাঁটার সময় জ্যাকেট খুলে ব্যাকপ্যাকে রেখেছিলাম। এখন দেখি, রীতিমতো শীত। অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছি আমরা, ঠান্ডায় কম্পমান সবাই। দ্রুত জ্যাকেট পরে নিই। তারপরও বাইরে দাঁড়ানো যায় না। একটু উষ্ণতার জন্য আমরা খাবারের তাঁবুর ভেতরে গিয়ে বসি। আলো থাকতে থাকতে সবাই নিজ নিজ তাঁবু বুঝে নিতে চেষ্টা করি। এদিন যেখানে আমরা রাত যাপন করি, সে জায়গার নাম মুবোয়া ক্যাম্প। এটি ২ হাজার ৬৫০ মিটার উঁচুতে। জায়গাটা অসমতল। অন্ধকারে তাঁবুর বাইরে হাঁটতে গেলে হোঁচট খেতে হবে।

বড় বড় গাছ দিয়ে ঘেরা জায়গায় আমাদের ক্যাম্প। রাতের খাবার শেষ করে শুতে যাওয়ার আগে দেখি, আকাশজুড়ে তারার মেলা। মেঘহীন পরিষ্কার আকাশ। তাই নক্ষত্রগুলো উজ্জ্বল আর অল্প চেনা নক্ষত্রপুঞ্জ স্পষ্ট দেখা যায়। ঢাকায় অথবা অন্য অনেক বড় শহরে এ দৃশ্য এখন দুর্লভ।
বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। তার সঙ্গে আছে হাড়কাঁপানো বাতাস। সেসব উপেক্ষা করে অনেকেই খোলা জায়গাতে দাঁড়িয়ে আকাশ ও নক্ষত্র দেখছেন। সন্ধ্যায় একবার আমাকে শীতে কাঁপতে দেখেছে ওয়াসিক। ও ওই গল্প সবাইকে না করলেই হয়। আর একবার ও রকম কাঁপুনি শুরু হতেই দৌড়ে তাঁবুতে ঢুকে যাই। স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে উষ্ণতার খোঁজ করি।
খুব ক্লান্ত না হলে কি এত তাড়াতাড়ি ঘুমানো যায়? ঘুমিয়ে পড়ার আগে অন্যান্য তাঁবু থেকে অণু, আনিস ভাই, তিন্নি ও জুইয়ের টুকরা কথা ও হাসি শুনতে পাই। ধীরে ধীরে সে শব্দও কমে আসে। নীরবতা ভেঙে মাঝেমধ্যে ভেসে আসে কোনো রাতপাখির ডাক। জীবনে এটাই আমার প্রথম তাঁবুবাস। আফ্রিকার অরণ্যের মাঝখানে ছোট্ট তাঁবুর নিচে ঘুমিয়ে পড়ার আগে এ জীবনকে স্বপ্নের মতো মনে হয়। (চলবে)

আরও পড়ুন