নেপালে তিন দিনের ইয়োগা রিট্রিট যেভাবে মনে আনল প্রশান্তি

বৃষ্টি না হলে খোলা আকাশের নিচে, অদূরে অন্নপূর্ণার সাদার মায়ায় করানো হয় যোগাসনের ক্লাস
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এবার টানা ১০ দিনের জন্য নিজেকে ছুটি দিয়ে দিলাম, সাতপাঁচ না ভেবে। ৯ এপ্রিল ছিলে আমার জন্মদিন। একা পাহাড়ের দেশে চলে গেলে কাছের মানুষদের বঞ্চিত করা হয়, তবু ভাবলাম, এ–ই হোক জন্মদিনে আমার নিজেকে দেওয়া উপহার। জন্মদিনটা বরং কাটিয়ে আসি পাহাড়ের সঙ্গে, পথে–প্রান্তরে, নিজেকে আরেকটু কাছ থেকে জানার চেষ্টায়।

তো এ–ই ছিল মোটামুটি আমার এবারের একক নেপাল ভ্রমণের সূচনা। এবার মূল গল্পে যাওয়া যাক। এই ১০ দিনে অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। পোখারা থেকে কাঠমান্ডুতে ফেরার সময় প্লেন খারাপ আবহাওয়ার কবলে পড়ায় মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে অনুভব করার অভিজ্ঞতাও হলো। তবে পুরো ভ্রমণ আজকের লেখার মূল বিষয় নয়, লেখার মূল বিষয় আমার তিন দিনের ইয়োগা রিট্রিট।

পাহাড়ের গ্রামের অরগানিক সব শাকসবজি, ফলমূল ছিল আমার তিন দিনের খাবার
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

শুরুতে কাঠমান্ডু হয়ে পোখারা। সেখানে দেখা হলো তরুণ প্রজন্মের প্রতিভাবান সিনেমাটোগ্রাফার সারাফাত রনির সঙ্গে, তার আরও কিছু ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ছয়জন একটা জিপ ভাগাভাগি করে গিয়েছিলাম মুস্তাংয়ে। চমৎকার মারফা ভিলেজ, প্রত্যন্ত কাগবেনি ঘুরে আমি চলে গিয়েছিলাম তিন দিনের জন্য ইয়োগা রিট্রিটকে, অন্নপূর্ণা ইকো ভিলেজে।

অনলাইনে আগেই বুক করেছিলাম মাদান ইয়োগা রিট্রিট ইন অন্নপূর্ণা ইকো ভিলেজ, আস্তাম। ১১ তারিখ বেলা ঠিক ১১টায় ওদের গাড়ি এসে থামল পোখারা ব্যাকপাকার্স হোস্টেলের সামনে। ফেওয়া লেক থেকে ২৫ মিনিটের মতো দূরত্বে পাহাড়ের ওপর ছোট্ট ছবির মতো সুন্দর অন্নপূর্ণা ইকো ভিলেজ। পৌঁছাতেই এক মগ গরম-গরম অরগানিক ক্যামোমাইল চা দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন ওদের কর্মী সুশীল। পাহাড়ের একদম মাথায় চারপাশে ঘর, মাঝখানে বিশাল উঠান। ভেতরে পা রাখতেই মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে গেল।

আরও পড়ুন
ভোরের সোনালি আভায় কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে চারপাশ
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ঠিক বেলা ১টায় দুপুরের খাবার। সুজির মতো, কিন্তু কালো দেখতে কোনো এক স্বাদহীন বস্তু খেলাম, নাম ঢিডো। নেপালের প্রধান খাবার। সঙ্গে সবজি, ডাল আর সব শেষে পাকা আম।

কোনো রকম মাছ–মাংস ছাড়া পাহাড়ের গ্রামের অরগানিক সব শাকসবজি, ফলমূল ছিল আমার তিন দিনের খাবার। সঙ্গে ছিল বিভিন্ন ধরনের অরগানিক চা। দুপুরের খাবার খেয়ে বের হলাম ভিলেজ হাইকিংয়ে।

বিকেল চারটায় ছিল প্রথম যোগাসনের ক্লাস। বের হয়ে দেখি, বৃষ্টি আসবে–আসবে অবস্থা। তাই পাহাড়ের ওপর ছাউনির নিচে ক্লাস নিলেন ইরুবিন। দারুণ এক নেপালি মেয়ে। হাসিতে অন্য রকম এক প্রশান্তি মাখা। ক্লাস করতে করতে হঠাৎ দেখি বিশাল এক রংধনু!

মোটামুটি প্রতিদিনের একই রুটিন। সকাল ৮টায় যোগাসন ক্লাস, ৯টায় নাশতা, বেলা ১১টায় ধ্যান, ১টায় দুপুরের খাবার, বিকেল ৪টায় যোগাসন ক্লাস, সন্ধ্যা ৬টায় ধ্যান, আবার ৭টায় রাতের খাবার। তারপরও প্রতিটি দিন ভীষণ অন্য রকম!

আমার ঘরে বিছানা থেকে জানালায় চোখ রাখলেই পুরো পাহাড়, আকাশ, নিচের গ্রাম একই ফ্রেমে ধরা দেয়। ফ্রেমের দৃশ্যপট একেক সকালে একেক রকম।

প্রথম দিন ঘুম ভাঙলে দেখি, ভোর সবে হতে শুরু করছে, সামনে পাহাড়ের মাথায় মেঘ ঝুলে আছে, আর ভোরের সোনালি আভায় কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছে চারপাশ! মনে হচ্ছে যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি কোনো!

এই একক ভ্রমণ ছিল জন্মদিনে আমার নিজেকে দেওয়া উপহার
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

পরদিন আবার একদম ভিন্ন রূপ! মেঘ কেটে যাওয়ায় আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অন্নপূর্ণা! ঘড়িতে বাজে মাত্র সাড়ে পাঁচটা। কিন্তু অমন সকালে আর ঘুমানো যায় না।

বৃষ্টি না হলে খোলা আকাশের নিচে, অদূরে অন্নপূর্ণার সাদার মায়ায় করানো হয় যোগাসনের ক্লাস।

কখনো গাইডেড মেডিটেশন, কখনো সেলফ মেডিটেশন বা আত্মধ্যান, কখনো সাউন্ড হিলিং। সাউন্ড হিলিং বা ধ্বনির মাধ্যমে নিরাময় একটি প্রাচীন ও শক্তিশালী থেরাপিপদ্ধতি, যেখানে ধ্বনি ও কম্পনের সাহায্যে শরীর, মন ও আত্মার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ, কোষ এমনকি আবেগেরও একটি নিজস্ব কম্পন–তরঙ্গ থাকে। শব্দ সেই কম্পনের সঙ্গে মিলে শরীরকে ভারসাম্য ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন
যোগাসনের পর অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করত
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আকাশ পরিষ্কার থাকলেই বিশালতা নিয়ে ধরা দেয় সবুজ, নীল, ধূসর পাহাড়ের পেছনে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে থাকা সাদা পাহাড়, অন্নপূর্ণা রেঞ্জ।

প্রথম দিন ডাইনিংয়ে আমি, দারিয়া, অ্যাঞ্জেলিনা, লোলা ও লুকাস এক টেবিলে বসলাম। গল্পে গল্পে জানলাম, ওরা সবাই যোগাসন শিক্ষক; প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। একেকজন পৃথিবীর একেক প্রান্ত থেকে এসেছে এই পাহাড়ের দেশে। একেকজনের একেক রকম গল্প।

দ্বিতীয় দিন সকালে যোগসনের ক্লাস নিল শ্যাংকি, ভারতের হৃষিকেশের ছেলে। আর বিকেলের ক্লাস নিল মাদান। যোগসনের এই আয়োজন শেষ হলো ওর মায়াবী বাঁশির সুরে। শেষ দিন ছিল আত্মধ্যানের। একেকজন একেক জায়গা বেছে নিল। আমি পাহাড়ের ধার ঘেঁষে কিছু দূরে গিয়ে একটু নেমে ধূসর পাহাড়ের দিকে মুখ করে বসে চোখ বন্ধ করলাম। ধীরে ধীরে আশপাশে থাকা প্রকৃতি যেন জীবন্ত হয়ে উঠল, হরেক রকম পোকামাকড়ের ডাক, দূরে পাখির ডাক, গাছের পাতাদের মর্মর, ঘাসের মৃদু ঘর্ষণের আওয়াজ—সব ছাপিয়ে নিজেকে ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করলাম, শোনার চেষ্টা করলাম।

ধ্যানেরর পর চোখ খুলে দূরের ওই জলরঙা পাহাড় দেখে মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় ছোট ছাদ থেকে বিপজ্জনকভাবে পা ঝুলিয়ে বসে, দূরের ধূসর পাহাড়চূড়া দেখে একাকী কাটানোর মুহূর্তগুলো। তারপর আরও কত কত মুহূর্তের ফিরে আসা!

একেবারেই নিজের মতো করে কাটালাম দিনগুলো
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এরপরই নবীন এসে জিজ্ঞেস করল, চা খাব কি না। সম্মতি জানাতে, আমার পাশ থেকেই নাগ দোনার গাছে থেকে পাতা ছিঁড়ে নিয়ে গেল, ভেষজ চা বানাতে। নাগ দোনার পাতার চা একটি প্রাচীন ভেষজ পানীয় যা প্রাকৃতিক উপায়ে হজমশক্তি বাড়ায়, নিদ্রা উন্নত করে এবং অনেক সময় স্বপ্ন দেখা আরও গভীর করে তোলে বলে মনে করা হয়।

ক্লাস শেষে আমার প্রিয় সকালের নাশতাটাও উঠানের বেঞ্চিতে বসে করলাম। দুপুরের খাবার একটু তাড়াতাড়ি সেরে নিলাম। সবাইকে বিদায় জানিয়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গন্তব্য পোখারা বিমানবন্দর। পাহাড়ি পথ ধরে গাড়ি যখন ছুটছে, আমি আবিষ্কার করলাম, অজান্তেই আমার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি।

আরও পড়ুন