ইচ্ছা করছিল বাস থেকে নেমে সবুজ ঘাসে শুয়ে পড়ি

চোখজুড়ানো সবুজের জন্যই বিখ্যাত সুইজারল্যান্ড
ছবি: লেখক

গত বছর মার্চে পর্তুগালের লিসবন থেকে ফ্রান্সের লিওন গিয়েছিলাম ঘুরতে। এ বছর আবারও সুযোগ এল ফ্রান্সের তৃতীয় বৃহত্তম শহর লিওন ভ্রমণের। লিওনকে বলা হয় চলচ্চিত্রের জন্মস্থান। চলচ্চিত্রের ইতিহাস পড়তে গিয়ে ক্লাসরুম থেকে প্রথমে জানতে পারি লুমিয়ের ব্রাদার্স সম্পর্কে। এই ‘ভাই-বেরাদরের’ বাড়ি ও জন্মস্থান ফ্রান্সের লিওনে। ১৮৯৫ সালে লিওনে তাঁদের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। সেই থেকে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ পরিচিত ফ্রান্সের এই পর্যটননগরী।
চার দিনের ভ্রমণে পরিকল্পনা ছিল, শুধু লিওন শহর ও আশপাশ ঘুরে দেখব। তবে এখানে আসার পর ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় কথা বলতে বলতে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিই, সুইজারল্যান্ড যাব। লিওন থেকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা সিটিতে পৌঁছাতে বাসে সময় লাগে মাত্র ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট। সকাল-সন্ধ্যা জেনেভা ভ্রমণের এই পরিকল্পনা শেষে আমরা অনলাইনে ফিলিক্স বাসের টিকিট কেটে ফেলি পরদিনের জন্য। ইউরোপের মধ্যে সড়কপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ফিলিক্স বাস বেশ জনপ্রিয়। যাওয়া-আসাসহ আমাদের দুজনের টিকিটের দাম পড়ল ৬৪ ইউরো (প্রায় ৭ হাজার ৬০০ টাকা)। ইউরোপে মূলত শীতকালে বাস ও বিমানভাড়া তুলনামূলকভাবে কম থাকে। ফলে কম খরচে ইউরোপ ভ্রমণের সুবর্ণ সুযোগ এ সময়েতেই।

ফ্রান্সে এই মৌসুমে শীত-বৃষ্টি একাকার হয়ে থাকে। পরদিন সকাল ছয়টা, বাইরে তখনো অন্ধকার। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা রওনা হই বাস টার্মিনালের দিকে। বাস নির্দিষ্ট সময়ে টার্মিনাল থেকে যাত্রা শুরু করে। আমার আসনটি জানালার পাশে বেছে নিলাম।

২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের পথ ।এই বাসে দুজনের টিকিটের দাম পড়েছিল প্রায় ৭ হাজার ৬০০ টাকা।
ছবি: লেখক

নতুন আরেকটি দেশে ঘুরতে যাচ্ছি। ভেতরে একধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। ঘণ্টাখানেক পথ পার হয়ে আসার পর আমরা সুইজারল্যান্ডের সীমানায় প্রবেশ করি। সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের জন্য মানুষের কেন এত আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা—মুহূর্তেই টের পেতে শুরু করলাম। রাস্তার দুধারে বনভূমি, সবুজ ঘাসের মাঠ, দূরের পাহাড়-পর্বত যখন চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল, তখন চোখ একমুহূর্তের জন্য অন্য কোথাও সরাতে পারছিলাম না। ছবিতে দেখা সবুজ–সুন্দর প্রকৃতি আর পাহাড়ের দেশ সুইজারল্যান্ড সত্যিকার অর্থেই যে প্রকৃতির রাজকন্যা, তা স্বচক্ষে দেখে অনুভব করলাম। আঁকাবাঁকা পথ আর পাহাড়তলে একের পর এক টানেল পেরিয়ে বাস চলছে সামনের দিকে। মাঝেমধ্যে দেখে অবাক হচ্ছিলাম, পাহাড় বাঁচানোর জন্য যাঁরা পাহাড় না কেটে নিচ দিয়ে টানেল বানায়, প্রকৃতি বোধ হয় সেখানেই তার সেরা রূপে হাজির হয়! চলতি পথে কখনো মনে হচ্ছিল, বাস থামিয়ে কোথাও একটু নেমে সবুজ ঘাসে শুয়ে পড়ি। অথবা কাঠের তৈরি ঘরগুলোর গ্রামে কয়েক কদম হেঁটে আসি। সৌন্দর্যের এমন রহস্য স্বপ্ন নাকি বাস্তব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

আরও পড়ুন

ভ্রমণের এই পথে আকাশজুড়ে ছিল মেঘের মেলা। ঘড়ির সময় তখন ১০টা ছুঁই ছুঁই। জেনেভা শহরে ঢোকার প্রবেশমুখে আমাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, অর্থাৎ ভিসা বা ইউরোপিয়ান রেসিডেন্সি পারমিট কার্ড দেখা হলো। ইউরোপের সেনজেনভুক্ত দেশগুলোয় বসবাসের এই একটি বড় সুবিধা—একটি রেসিডেন্সি পারমিট কার্ড দিয়ে আপনি অনেকগুলো দেশ যখন খুশি ভ্রমণ করতে পারবেন। চেকিং শেষে আমাদের বাস আবার শহরের দিকে যাত্রা শুরু করে। তার অল্প কিছুক্ষণ পর আমরা জেনেভা শহরে পৌঁছাই। বাস থেকে নেমে একটা কফি শপে কিছুক্ষণের বিরতি নিই। সুইজারল্যান্ড ইউরোপীয় সেনজেনভুক্ত দেশ হলেও এখনকার মুদ্রা হলো সুইচ ফ্রাঁ। তবে এখানে ফ্রাঁর বদলে ইউরোও চলে। অর্থাৎ সুইচ ফ্রাঁ এবং ইউরো—দুই ধরনের মুদ্রা দিয়ে আপনি লেনদেন করতে পারবেন। তবে ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় সুইজারল্যান্ড অনেক ব্যয়বহুল।

ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় সুইজারল্যান্ড অনেক ব্যয়বহুল
ছবি: লেখক


বাসে বসেই দিনের ভ্রমণপরিকল্পনাটা সাজিয়ে রেখেছিলাম। গুগল ম্যাপ দেখে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটে আমরা পৌঁছাই জারদিন আংলাইসে। এটি শহরে অবস্থিত বিশাল একটি লেক, যার চারপাশে রয়েছে হাঁটাপথ ও ফুলের বাগান। লেকে ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে ছোট ছোট জাহাজ, স্পিডবোটসহ নানা নৌযান। ঠিক লেকের মধ্যখানে আছে একটি ফোয়ারা। অনেক উঁচু থেকে ঝরনার মতো পানি বেয়ে পড়ে। ফোয়ারার কাছে দর্শনার্থীদের ভিড় দেখে আমরাও এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। আবার এখানে দাঁড়িয়ে দেখা মেলে দূরের পর্বতমালায় জমে থাকা তুষার।
লেক ঘুরে দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। শহরের রাস্তাগুলো বেশ সাজানো–গোছানো। জেনেভা শহরের পথ এতই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যে খুঁজেও একটা আবর্জনা পাওয়া যাবে না। শহরে নেই কোনো যানজট। ফুটপাত ধরে আবারও আমরা হাঁটতে লাগলাম। একটু সামনে এসেই খুঁজে পাই কেএফসি। দুপুরের খাবার সেরে রওনা হই শহরের অন্যদিকে অবস্থিত জাতিসংঘের কার্যালয় দেখতে। জেনেভায় অবস্থিত এই কার্যালয় দেখতে প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী সকাল-সন্ধ্যা ভিড় জমায়। চাইলে এর ভেতরে ঢুকে ঘুরে দেখার ব্যবস্থাও আছে। তবে এক থেকে দুই মাস আগে অনলাইনে টিকিট বুক করে রাখতে হয়। টিকিটের জন্য মূল্যও নির্ধারণ করা আছে।

আরও পড়ুন

এখান থেকে কয়েক পা ফেললে সামনেই আছে বিখ্যাত ‘ব্রোকেন চেয়ার’।
জেনেভায় কেউ ঘুরতে এলে সাধারণত ব্রোকেন চেয়ার না দেখে ফেরে না। তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙা চেয়ারটি মূলত ল্যান্ডমাইনের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রতীক। ৫ দশমিক ৫ টন কাঠ দিয়ে তৈরি এই চেয়ারের উচ্চতা ৩৯ ফুট। ভিন্নধর্মী এই স্থাপত্যের সামনে দ্রুত কয়েকটি ছবি তুলে আবার রওনা হই সামনে।

এই ভাঙা চেয়ার না দেখে সাধারণত জেনেভা থেকে কেউ ফেরে না
ছবি: লেখক


বেলা বাড়ার সঙ্গে বৃষ্টি আরও বাড়ছিল। হাতে সময় কম, তাই আমরা থেমে না থেকে আরও প্রায় আধা কিলোমিটার পথ হেঁটে পৌঁছে যাই সুইস মিউজিয়াম অব সিরামিক অ্যান্ড গ্লাসে। বাইরে থেকে ভবনটি দেখলে মনে হবে কোনো এক জমিদারবাড়ি। সিরামিকের জন্য বিশ্বব্যাপী সুইজারল্যান্ডের আলাদা একটা সুনাম রয়েছে। তারই প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এই জাদুঘর। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই এক নারী হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানান। সুইস নাগরিকেরা বেশ আন্তরিক। আরও বড় সুবিধা হলো, এখানকার নাগরিকেরা পর্যটকদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন। সুতরাং যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষাগত কোনো জটিলতায় পড়া হয়নি। প্রথমে কথা বলে জেনে নিলাম জাদুঘরটি ঘুরে দেখার দিকনির্দেশনা। দর্শনার্থীদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি এটি। বিভিন্ন দশকের সিরামিক এবং কাচের তৈরি শিল্পকর্ম দেখে বেশ অবাক হয়েছি। ১ হাজার ২০০ বছরের পুরোনো প্রায় ২০ হাজার সিরামিক ও কাচের তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম এই জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। জাদুঘরটি ঘুরে ঘুরে দেখলে যে কেউ খুব সহজে সুইজারল্যান্ডের সিরামিক শিল্পের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে পারবে।

জাতিসংঘের কার্যালয়ের সামনে লেখক


ফ্ল্যাশব্যাকে ইতিহাসের পাতায় ঘুরপাক খেতে খেতে ফেরার সময় হয়ে এল। একটা কফি-বিরতি নিয়ে সন্ধ্যা সাতটার ফিরতি বাসে রওনা করে আবার রাত ১০টার মধ্যে ফিরে আসি লিওনে। সব মিলিয়ে লিওন থেকে আসা-যাওয়া এবং খাবার খরচ মিলিয়ে এক দিনে দুজনের ব্যয় হয় প্রায় ১০৭ ইউরো, যা বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় ১৩ হাজার টাকা।
সুইজারল্যান্ড সত্যিই সীমাহীন সৌন্দর্যের শীর্ষে। ১৫ ঘণ্টার এই ভ্রমণ মনে শান্ত শীতল স্মৃতি হয়ে আজীবন থেকে যাবে, এটা নিশ্চিত।