অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্‌যাপিত হলো জন্মদিন

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন দ্বাদশ পর্ব

জোডিয়াকে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

জোডিয়াকে এক রুশ অভিযাত্রী বড় সাইজের চারটি ক্যামেরা নিয়ে উঠেছে। তার ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে, অ্যান্টার্কটিকার কোনো অংশের ছবি তোলাই সে বাদ রাখবে না। যেমন তার ক্যামেরার বহর, তেমনই দশাসই শরীর। আমি ক্যামেরা তাক করলেই তার শরীরের কোনো না কোনো অংশ ফ্রেমের মধ্যে ঢুকবেই। এ কী জ্বালা, কিছু বলাও যায় না, সওয়াও যায় না!

তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে রেখেছে। জোডিয়াকে কেবল নিজেদের শ্বাস–প্রশ্বাস আর ক্যামেরার শাটারের শব্দ। পরিস্থিতি এমন, মৃত্যুর আশঙ্কা আছে জেনেও তিমির ছবি তোলা ছাড়া আমাদের আর কোনো কর্তব্য নেই। আমি করুণ চোখে সেরেনার দিকে তাকাই। যদিও বৃহৎ তিমির শক্তির কাছে সে পিঁপড়া, কিন্তু সে-ই তো এই বিপুল জলরাশিতে আমাদের পথপ্রদর্শক। সেরেনা বেশ স্বাভাবিক। সে শুধু বলল, এসব তিমির মধ্যে একটা নীল তিমিও আছে।

আমাদের ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক কি তিমিগুলো শুনতে পাচ্ছে? অদূরেই একটা তিমি। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দ্রুত। এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভয়ে একে অন্যের গা ঘেঁষে বসার চেষ্টা করছি। এক হাত ব্যবধানে এসে ডিগবাজি দিল তিমি। আমাদের গায়ে এসে লাগল পানির ছিটা। আমার ক্যামেরা ক্লিক করতে যত সময় নিচ্ছে, তিমি ডিগবাজি দিতেও ঠিক ততক্ষণ সময় নিচ্ছে। এই তিমির ছবি তুলতে যখন ব্যস্ত, তখন পেছন থেকে জোডিয়াকে মৃদু ধাক্কা দিল আরেক তিমি। লেজ উঁচিয়ে ডুবে গেল। ‘ভি’ আকৃতির লেজ। সব সময় সে বিজয়চিহ্ন দেখিয়ে তবে প্রস্থান করে। সত্যি তো, তাকে কেউ কখনো পরাজিত করতে পারে বলে শুনিনি। এটি তার রাজ্য, আমরা অতিথিমাত্র, অনাহূত অতিথি। তিমির মুখ স্পষ্ট দেখতে পাইনি। কেবল শিরদাঁড়া আর লেজ দেখেছি। দ্রুততম সময়ে এ কাণ্ড তারা ঘটায়। লুকোচুরি খেলা।

নীল তিমি বেলিন প্রজাতির, অর্থাৎ তাদের দাঁত নেই। দাঁতের বদলে আছে আঁশযুক্ত ‘বেলিন’ প্লেট। এই প্লেটের মাধ্যমে ক্রিল, প্লাঙ্কটন গিলে ফেলে। খাবার আটকে যায়, কিন্তু পানি বেরিয়ে যায় মুখ থেকে। সেরেনা জোডিয়াকের ইঞ্জিন চালু করছে না, অর্থাৎ এখনো আমাদের আশপাশেই আছে তিমিগুলো। অদূরে পানিতে অনেক বুদ্‌বুদ। হঠাৎ এর অর্থ খুঁজে পাই না। সেরিনা ফিসফিস করে বলে, তিমিগুলো খাবার ধরার জন্য এই বুদ্‌বুদ তৈরি করেছে। এই বুদ্‌বুদ জালের মতো। এখানে সামুদ্রিক প্রাণী আটকে যায়, শিকারকে যেতে হয় তিমির পেটে। তিমির খাবার ধরার একটা চমকপ্রদ কৌশল এটি। তিমি বেশ চতুর। ছলচাতুরী জানে ভালো। এই বুদ্‌বুদকে বলে ‘বাবল নেট’। কিছুক্ষণের মধ্যে এই বুদ্‌বুদ মিলিয়ে গেল। ‘বাবল নেট’ দেখলাম, কিন্তু পানির নিচে শিকার কীভাবে ধরল, সেটা দেখার সুযোগ নেই। বুদ্‌বুদ মিলিয়ে গেল, সেরেনা ইঞ্জিন চালু করল।

অ্যান্টার্কটিকায় আর্জেন্টিনার একটি স্টেশন
ছবি: লেখক

ধীরে ধীরে জাহাজের অন্য জোডিয়াকগুলোও আমাদের কাছে আসতে শুরু করেছে। কাছাকাছি পাঁচ থেকে ছয়টি জোডিয়াক। সবার পরনে লাল পোশাক। আকাশে রংধনু উঠেছে। আমরা পানি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়েছি আকাশে—ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।

একটি পাথুরে পাহাড়ের পাদদেশে এসে থামল জোডিয়াক। সেখানে দু–তিনটি ঘর। জনমানব নেই। আমাদের দেশের গ্রামের টিনের ঘরের মতো। ঘরের দেয়ালে আঁকা আছে একটি পতাকা। পতাকাটা আমার খুব চেনা। আর্জেন্টিনার পতাকা। অ্যান্টার্কটিকায় অনেক দেশের থাবা পড়েছে, তার মধ্যে আর্জেন্টিনাও আছে। আর্জেন্টিনা মনে করে, এটি তার বাড়ির পেছনের অংশ। তবে কাড়াকাড়িতে সে খুব একটা সফল হতে পারেনি। বেশি এগিয়ে যুক্তরাজ্য। এটি আর্জেন্টিনার একটি স্টেশন। নাম ব্রাউন স্টেশন। আর্জেন্টিনার ‘নৌবাহিনীর জনক’ অ্যাডমিরাল উইলিয়াম ব্রাউনের নামে নাম। আর্জেন্টিনা দাবি করে, এটি তাদের একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা স্টেশন। কিন্তু আমাদের গাইড সেরেনা বলল, ‘যতবার আসি, কেবল আর্মি অফিসার দেখি; আর জানতে চাইলেই বলে, গবেষণার কাজে এসেছে। অ্যান্টার্কটিকায় আর্জেন্টিনা পরিচালিত ১৩টি গবেষণাঘাঁটির একটি ব্রাউন। ১৯৫১ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এটি স্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে কাজ করে। ১৯৮৪ সালে স্টেশনটি একবার পুড়ে যায়। সেই থেকে এর স্থায়ী কার্যকলাপ বন্ধ। তার পর থেকে এটি শুধু গ্রীষ্ম মৌসুমে খোলা থাকে। এখানে ১৮ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে।

ফেরার পথে আরও কিছু তিমির জলক্রীড়া দেখলাম। ভয় কমেছে, কৌতূহল বেড়েছে। শরীর খুব ক্লান্ত, কিন্তু মন প্রফুল্ল।

রাতের খাবারের ঘোষণা এল। রেস্তোরাঁয় আবার একসঙ্গে আমরা চার নারী। বিশেষ এক কারণে আজ আমাদের মনও বেশ প্রফুল্ল। আজ ক্যারোলিনের জন্মদিন। তিনজন মিলে ক্যারোলিনকে অনাড়ম্বর শুভেচ্ছা জানালাম। খাওয়াদাওয়া প্রায় শেষ। তৃতীয় দফা ডেজার্ট আর আইসক্রিম নিয়ে বসেছি। নিচু ভলিউমে সুর বাজছে। হঠাৎ ঝলমল করে উঠল রেস্তোরাঁ, উঁচু স্বরে বেজে উঠল—‘হ্যাপি বার্থডে’।

জাহাজের সব রসিক আমুদে ক্রু নাচতে নাচতে এসে ঘিরে ধরল আমাদের টেবিল। হাতে কেক ও মোমবাতি। কী জয় করেছি আমরা? সে আর কিছু নয়, আজ ক্যারোলিনের জন্মদিন। ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে গেল কক্ষের সবাই। মুখর হয়ে উঠল জাহাজের খাবারকক্ষ। চারদিকে মুহুর্মুহু করতালি। ক্যারোলিন তার জন্মদিনের কেক কাটছে। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রী ও ক্রুরা এক মহোৎসব উদ্‌যাপন করছে।

(চলবে)

আরও পড়ুন

১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?

২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা

৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’

৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি

৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি

৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী

৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি

৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়

৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম

১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই

১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল