ছয় মাস ধরে অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের গল্প লিখেছি প্রথম আলোতে
কারও কৈশোরে, কারও বা তারুণ্যের শুরুতে প্রথম আলোর সঙ্গে পরিচয়। এই পত্রিকার পাতায় রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, দেখেছেন তাঁদের মতো হওয়ার স্বপ্ন। এখন তাঁরাই আবার পত্রিকায় পাতায় অন্যদের স্বপ্ন দেখান। প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে এমন চার রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের গল্প প্রকাশ করেছে শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। এখানে পড়ুন পর্যটক ও লেখক মহুয়া রউফের অভিজ্ঞতা।
অ্যান্টার্কটিকা সফর শেষে জাহাজ থেকে নেমেই জানতে পারলাম, যে এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে আর্জেন্টিনা থেকে কানকুন হয়ে আমার দেশে ফেরার কথা, সেটি দেউলিয়া হয়ে গেছে। সেই রাতে দিশাহারা হয়ে বিমানবন্দরের মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখি, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ—আমার অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের গল্প পাঠকদের শোনাতে চায় প্রথম আলো। নানান হাঙ্গামার পর ফেরার অনিশ্চয়তা যখন কেটে গেল, তখন জনমানবহীন মহাদেশ ভ্রমণের সামান্য অভিজ্ঞতা লিখে পাঠিয়ে দিলাম। ততক্ষণে আমেরিকায় পৌঁছে গেছি। এক নির্জন সন্ধ্যায় ল্যাপটপে প্রথম আলো খুলে দেখি, পর্দায় নিজের নাম আর বরফে মোড়ানো আমার সেই দুঃসাহসিক যাত্রার ছবি! দেশে ফেরার আগেই অভিযানের গল্প প্রকাশিত হলো ‘ছুটির দিনে’য়, প্রথম আলোর পাতায়।
এ ঘটনার বছর তিনেক আগের কথা। করোনা যখন খুব জেঁকে বসছে, চারদিক স্থবির, সে সময় ঘরে বসে অফিস করছি আর অবসরে আগের ভ্রমণগল্পগুলো লিখছি। অনেক আগে থেকে লেখাজোখা করলেও সেগুলো প্রকাশে উদাসীন ছিলাম। তবে করোনাকালে একটি লেখা পাঠালাম পশ্চিমবঙ্গের ভ্রমণ ম্যাগাজিনে। শারদীয় সংখ্যায় তারা সেটি ছাপল। এই লেখার সূত্র ধরেই একদিন প্রথম আলো থেকেও যোগাযোগ করল। একটি ভ্রমণ গদ্য লিখে পাঠালাম। প্রকাশিত হলো। শুরু থেকেই প্রথম আলোর পাঠক ছিলাম, সেবার লেখক হলাম।
অ্যান্টার্কটিকা সফর শেষে দেশে ফেরার পর ‘ছুটির দিনে’র পক্ষ থেকেই একদিন অভিযানের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে অনলাইনে লেখার জন্য জানানো হলো। ২০২৩ সালে শুরু করলাম লেখা। পাঠকের প্রতিক্রিয়া ছিল অভূতপূর্ব। প্রথম আলোর পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিক্রিয়া আমার লেখকসত্তাকেও দৃঢ় করেছে।
একদিন প্রথম আলো অফিসে অ্যান্টার্কটিকার গল্প শোনাতে গেলাম। সেখানে ঢোকার সময় মনে হচ্ছিল, সময়ের যে নীরব ঘূর্ণিতে ছিলাম এত দিন, আজ তার কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছি। চারদিকে পরিচিত-অপরিচিত হাসিমুখ আমায় স্বাগত জানাচ্ছেন, মাঝখানে বসে আমি আমার ভ্রমণের গল্প বলছি। গল্প শেষে পত্রিকাটির সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হলো। শিশু বয়স থেকেই তাঁর নামটি আমার মুখস্থ। তখন আমাদের বাসায় একতা পত্রিকা আসত। আব্বা বলতেন, এ পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান। আমি বুঝেছিলাম, সম্পাদক মানে যিনি বসে বসে এ পত্রিকাটি নিজ হাতে লিখেছেন আর তাঁর হাতের লেখা বইয়ের লেখার মতোই সুন্দর। খবরের কাগজ যে মেশিনে ছেপে বেরিয়ে আসে, সেই বুঝ আমার বেশ বড় হওয়ার পর হয়েছিল।
ছয় মাস ধরে অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের গল্প লিখলাম। এই ছয় মাস আর কোথাও অ্যান্টার্কটিকা বা অন্য কোনো বিষয়ে ভ্রমণগল্প লিখিনি। না, কেউ আমায় দিব্যি দেননি যে এ বিষয়ে অন্য কোথাও লেখা যাবে না। আমিই লিখিনি। এ সিদ্ধান্ত আমার কাছে আমার নৈতিকতার চর্চা। এর ফলও পেয়েছি। অ্যান্টার্কটিকা অভিযান নিয়ে প্রথম আলোয় যা লিখেছি, তার দ্বিগুণের বড় পাণ্ডুলিপি তৈরি করলাম। প্রথমা প্রকাশন প্রকাশ করল আমার প্রথম ভ্রমণগ্রন্থ দখিন দুয়ার খোলা। ২০২৪ সালে বইটি প্রকাশের পর ভাবছিলাম, ধীরে ধীরে পাঠকের কাছে পৌঁছাবে আমার বই। হয়তো কয়েক মাস পর কোনো প্রতিক্রিয়া পাব। তবে যা ঘটল, তা অবিশ্বাস্য। প্রকাশের মাত্র ছয় দিনের মধ্যে দখিন দুয়ার খোলার প্রথম মুদ্রণ শেষ! প্রথম মুদ্রণ শেষ হওয়া শুধু একটি পরিসংখ্যান নয় আমার কাছে, এটি আমার লেখকজীবনের একটি মাইলফলক। আনন্দ, গর্ব, বিস্ময় আর দায়িত্ব নিয়ে আমি আবার লিখতে শুরু করলাম।
এ বছর প্রথমা প্রকাশন প্রকাশ করল আমার দ্বিতীয় ভ্রমণগ্রন্থ লাতিনের নাটাই। প্রথম আলোর পাঠক থেকে এবার পরিপূর্ণ লেখক হয়ে উঠলাম। তবে লেখক হলেও আজও আসলে আমি প্রথম আলোর পাঠকই।