সারা দিনের ট্রেক শেষে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে

নেপালের পোখারা থেকে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প—সব মিলিয়ে ১০ দিনের ট্রেক। পথটা দুর্গম, তবে অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। হিমালয়ের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ভুলিয়ে রাখে গন্তব্যে পৌঁছার কষ্ট। যেতে যেতে আরও কত কি যে চাক্ষুষ হয়! মে মাসে পার্বত্য এই পথেই হেঁটে এসেছেন ইফতেখারুল ইসলাম। সেই অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। আজ পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব

অন্নপূর্ণার পথে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

গত বছরের কয়েকটা ট্রেকে পথে পথে ও বিভিন্ন লজে যত ট্রেকার দেখেছি, এবার তার তুলনায় ট্রেকারের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। রাস্তায় নানা বয়সের অসংখ্য নারী-পুরুষকে এবিসির (অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে) দিকে যেতে বা সেখান থেকে ফিরে আসতে দেখেছি। কফি বা লাঞ্চের জন্য যেসব জায়গায় থামি আর রাতযাপনের জন্য যে লজেই যাচ্ছি, সবখানে ভিড় অনেক বেশি। বিশেষ করে হিমালয়াতে এসে ভিড়টা বেশি চোখে পড়ে। কারণ, এখানে দুটি মাত্র লজ।

গাইডরা আমাদের সবার জন্য ট্রেকিং পারমিট নিয়ে থাকেন। তাই তাঁরা জানবেন, প্রতিবছর পর্যটক আসা কতটা বাড়ছে। এ বিষয়ে আমার গাইড তেজ ও অন্য দু-একজনের সঙ্গে আমি কথা বলি। জানতে চাই, করোনা মহামারির পর নেপালের পর্যটন পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হয়েছে? প্রত্যেকেই আমাকে জানান, করোনাপূর্ব সময়ের তুলনায় এখন হিমালয়জুড়ে ট্রেকার ও পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পুরো দ্বিগুণ না হয়ে থাকলেও সংখ্যাটা ২০১৯ সালের তুলনায় ৭০-৮০ শতাংশ বেশি হবে।

পরদিন, মানে ৭ মে ভোরে ব্রেকফাস্ট সেরে সময়মতো বেরিয়ে পড়তে কোনো অসুবিধা হয় না। এ ট্রেক দীর্ঘ হবে। তবে এদিন অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে পৌঁছাব বলে সারা মনে অন্য রকম একটা উত্তেজনা রয়েছে। মনে পড়ল, মাস দেড়েক আগে মনিরুল ও তাঁর স্ত্রী কানিজ তাঁদের এই চূড়ান্ত দিনের বিবরণ লিখেছিলেন ফেসবুকে। দুজনেই চমৎকার লেখেন। কে কার চেয়ে ভালো লিখেছিলেন, তা বলা কঠিন, কিন্তু আমি মন দিয়ে দুজনের লেখাই পড়েছি। এ যাত্রাপথ যেমন অভাবনীয় সুন্দর, তুষারশুভ্র পাহাড়ের দেশে অভিযাত্রীর বেশে এগিয়ে চলার এই অভিজ্ঞতাও অনন্যসাধারণ। গত মার্চে তাঁদের এবিসিতে যাওয়ার দিনটিতে আবহাওয়া বেশ প্রতিকূল ছিল। সে সময় কয়েক দিন ধরে ক্রমাগত তুষারপাত হয়। বিশেষ করে দেউরালির পর থেকে পুরো ট্রেকের পথে এক ফুট উঁচু হয়ে তুষার জমেছিল। প্রায় হাঁটুসমান গভীর তুষারের ওপর দিয়ে পথ চিনে ট্রেক করে চলা সহজ নয়। অনেককেই ফিরে আসতে হয়েছিল। মনিরুল ও কানিজ তাঁদের দৃঢ় মনোবল ও আন্তরিক পরিশ্রম দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন। আজ কী হবে, কে জানে!

একটু সামনেই অ্যাভালাঞ্চ হয়ে বরফ ও পাথর ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ট্রেকিং শুরু করে সকালের দেড় ঘণ্টা আমার বেশ সহজ ও সুন্দরভাবে কেটে যায়। সকাল নয়টায় দেউরালিতে পৌঁছে একটু বিরতি নিই। হানি-লেমন চা খাই। বিরতির পর সেখান থেকে আধঘণ্টা ট্রেক করে একটা জায়গায় পৌঁছে দেখি, ‘অ্যাভালাঞ্চরিস্ক এরিয়া’ বা ‘বরফধস ঝুঁকির এলাকা’ বলে সাইন দেওয়া আছে। তেজ বললেন, ‘এখন আমাদের এ পথ ছেড়ে নিচে নেমে যেতে হবে বিকল্প পথের দিকে।’ ‘কেন? ঝুঁকি থাকলে সতর্ক হব; অন্য পথে যাব কেন?’ তেজ বুঝিয়ে বললেন, একটু সামনেই একটা জায়গায় কয়েক দিন আগে অ্যাভালাঞ্চ হয়ে বরফ ও পাথর ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। ওই পথে চলাচল নিষেধ। অতএব নিচে নেমে গিয়ে পাথরের ওপর পা ফেলে ফেলে মোদিখোলা নদী পার হয়ে অন্য পারে উঠতে হবে।

রীতিমতো একটা পাহাড়ি নদী। একেবারে ক্ষীণ নয় তার স্রোতোধারা। তবে পুরো নদীর বুকে ছড়ানো রয়েছে ছোট-বড় অনেক পাথর। কোনো সেতু ছাড়া, শুধু পাথরের ওপর পা ফেলে ফেলে মোদিখোলা নদী পার হয়ে অন্য পারে উঠে যেতে পেরে মজা লাগে। ওপারে বেশ কিছু দূর হেঁটে আবার নিচে নেমে নদী পার হয়ে এপারে ফিরে আসতে হয়। পুরো দেড় ঘণ্টা বাড়তি হেঁটে আমরা শেষ পর্যন্ত অ্যাভালাঞ্চ এলাকাটা পার হয়ে যেতে সক্ষম হই।

মচ্ছপুছারে বেজক্যাম্পে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এ সময়টুকু অতিরিক্ত ব্যয় হলো, আর পরিশ্রম বেশি হলো বলে আমি একটু বিপর্যস্ত বোধ করি। ক্লান্তির কারণে হাঁটার গতি কমে যায়। তবু দুপুরে খাওয়ার সময় আমরা ঠিকই মচ্ছপুছারে বেজক্যাম্পে (এমবিসি) পৌঁছে যেতে সক্ষম হই। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে একেবারে ওপরের লজে গিয়ে আমরা বসি। হাঁটতে যত কষ্টই হোক, আজ আবহাওয়া ছিল দারুণ। সকালে চারদিকে রোদ–ঝলমলে পাহাড়, নীল আকাশ আর দূরের পর্বতশিখর দেখতে দেখতে হেঁটেছি। দুপুর হতেই মেঘ জমতে শুরু করে। এখানে এসে খাবার অর্ডার দেওয়ার সময় দেখি, বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হালকা বৃষ্টির সঙ্গে প্রথমে মনে হয়েছিল তুষার ঝরছে। পরে দেখি তুষার নয়, আসলে ঝরছে ছোট ছোট বরফকণা। অনেকটা শিলাবৃষ্টির মতো। কিন্তু শিলাগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো।

বৃষ্টি বা তুষার কোনো কিছুতেই আমাদের থেমে থাকা চলবে না। দুপুরের খাওয়া শেষ করে রেইন পঞ্চো পরে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই আমরা আবার আমাদের ট্রেকিং শুরু করি। এমবিসি থেকে যাত্রা শুরু করার ১০-১৫ মিনিট পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসে। আকাশের গায়ে দেখা দেন মচ্ছপুছারে ও অন্যান্য পর্বতশিখর। এত কাছে থেকে এই পর্বতশিখরগুলোকে রাজসিক দেখায়।

এখানে পুরো পথ তুষারে আবৃত। পাশেই হিমবাহ—‘সেথা সাদা বরফের বুকে নদী ঘুমায় স্বপনসুখে’। এই হিমবাহ, চারদিকের ছোট-বড় সব পাহাড় আর দূরের পর্বতশিখর—সবই ঝকঝকে সাদা। অন্নপূর্ণা সাউথের গ্লেসিয়ারের গ্রাবরেখা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চারদিকের শুভ্র সৌন্দর্য দেখি। মে মাসের শুরুতে এ অঞ্চল পুরো তুষারাবৃত দেখছি। মার্চে এলে তুষারের ওপর দিয়ে হাঁটতে হতো আগের দুটো দিনও। এতে একটু কষ্ট হলেও সেটাই আসলে হিমালয়ে আসার জন্য আমার বেশি প্রিয় সময়।

আগেই ট্রিলাইন পার হয়ে এসেছি। এখানে কোনো বৃক্ষ নেই। ছোট ঝোপ বা লতাগুল্মও দেখা যায় না। তবে কিছু ঘাস ও নানা রকম প্রাণের চিহ্ন রয়েছে সবখানে। কয়েক দিন ধরে ট্রেকিংয়ের পথের পাশে ছোট ছোট গাছের আড়াল থেকে নানা রকম পাখির ডাক শুনেছি। এ তুষারের রাজ্যেও নানা রঙের পাখি উড়ে বেড়ায়। তেমনি তুষারঢাকা পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দেয় বাদামি রঙের একরকম ইঁদুর—হিমালয়ান পিকা। দেখতে ঠিক ছোট খরগোশের মতো।

প্রথমে আমি তাদের ছোট আকারের খরগোশ বলেই ভেবেছিলাম। তেজকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানান, এদের নাম হিমালয়ান পিকা। তুষারের দেশের বিপন্ন প্রজাতির তৃণভোজী প্রাণী। অনেক দেশেই তাঁরা বিলুপ্তপ্রায়। তবে নেপালে এভারেস্ট ও অন্নপূর্ণার পার্বত্য এলাকায় আড়াই হাজার মিটার থেকে সাড়ে চার হাজার মিটার উচ্চতায় তাদের দেখা যায়।

তুষারঢাকা পর্বতশিখরের কাছে এসে ‘প্রাণের চিহ্ন’ কথাটা মনে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও অন্য রকম প্রাণের চিহ্ন দেখতে পাই। পার্বত্য পথের বিভিন্ন জায়গায় আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট স্থান আছে। আমি ও অন্য অনেকেই চেষ্টা করি নিজের ব্যবহৃত খাবার ও অন্যান্য জিনিসের বর্জ্য নিজের সঙ্গে করে ফেরত নিয়ে আসতে। এই পুরো অঞ্চল প্লাস্টিকবর্জিত এলাকা হলেও এখানে–ওখানে পানীয়ের বোতল ও চকলেটের খোসা পড়ে থাকতে দেখি। কোথাও কোথাও নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখে মন খারাপ হয়। এমনই কোনো একটা জায়গায় ইংরেজি ও নেপালি ভাষায় মুদ্রিত বাংলাদেশি পটেটো ক্র্যাকারসের খালি প্যাকেট দেখি। কোনো কোনো লজেও এই নামের চিপস ও জুস বিক্রি হতে দেখেছি। এ আরেক প্রাণের চিহ্ন। বাংলাদেশের পণ্য কত দূর পর্যন্ত পৌঁছেছে, তা দেখে একটু অবাক লাগে।

অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে পৌঁছানোর পর
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

শুভ্র তুষারের রাজ্যে হাঁটতে হাঁটতে ক্রমান্বয়ে উঁচুতে উঠতে থাকি। একসময় সামনে অনেক দূরে দেখতে পাই নানা রঙের প্রেয়ার ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজানো আর সাইনবোর্ড দেওয়া একটা জায়গা। এত দূর থেকে সেই সাইনবোর্ডের লেখা পড়া যায় না। তবে ওখানে কী লেখা আছে, তা আমার ও অন্য অনেকেরই জানা। বিকেল ঠিক সওয়া চারটায় আমি সেই ফলকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ওখানে যে কজন ছবি তুলছিলেন, তাঁরা আমাকে স্বাগত জানান। তাঁদের পাশে ডেকে নেন। সবাই একে অন্যকে অভিনন্দন জানাই। সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা আছে—‘নমস্তে’। তার নিচে—‘অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে, এবিসি ৪১৩০ মিটার’। বেশ কয়েকটা ছবি তোলা হয়। ছবি থাকুক আর না থাকুক, এ রকম মুহূর্ত এমনিতেই অবিস্মরণীয়। তার চেয়ে অবিস্মরণীয় ছিল পরের দিনের সূর্যোদয়। অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পের অপরূপ ভোর।