ঝরনা ও অরণ্য পেরিয়ে হিমালয়ার হিমসন্ধ্যা

নেপালের পোখারা থেকে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প—সব মিলিয়ে ১০ দিনের ট্রেক। পথটা দুর্গম, তবে অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। হিমালয়ের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ভুলিয়ে রাখে গন্তব্যে পৌঁছার কষ্ট। যেতে যেতে আরও কত কি যে চাক্ষুষ হয়! মে মাসে পার্বত্য এই পথেই হেঁটে এসেছেন ইফতেখারুল ইসলাম। সেই অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব

ট্রেকের নানা জায়গা থেকে দেখা যায় চেনা পর্বতশিখর
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

পরের দিনের ট্রেক আমার জন্য একটু দীর্ঘ। কিন্তু এখানে সকাল সাতটার আগে ব্রেকফাস্ট তৈরি হবে না। তাই সাড়ে সাতটায় বের হব। ৬ মে ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে সূর্যোদয় দেখতে পাই। ভোরের আলোয় ঝকঝকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অন্নপূর্ণা সাউথ, হিউঞ্চুলি, অন্নপূর্ণা ৩ আর বিখ্যাত ফিশটেইল। ব্যাগ গুছিয়ে, ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে সাড়ে সাতটায় পথে নামি। ছমরং ছিল ২ হাজার ২১০ মিটার উচ্চতায়। আর আজ হিমালয়াতে গিয়ে পৌঁছাব ২ হাজার ৯৫০ মিটার উচ্চতায়। এবিসির (অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প) পথে এখানে একটা ছোট্ট জায়গার নাম হিমালয়া; যদিও হিমালয়াজ বলতে আমরা পুরো হিমালয় পর্বত বুঝি।

এমনিতেই আজকের ট্রেকটা বেশ দীর্ঘ। তার ওপর এক দিনে অনেকটা উঁচুতে ওঠা। সব মিলিয়ে কাজটা সহজ নয়। বিশেষ করে অনভিজ্ঞ ট্রেকারদের কাছে এই দিনের ট্রেক বেশ কঠিন। আসলে পার্বত্য পথে ট্রেক করতে গেলে প্রতিদিনই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। দৃঢ় প্রত্যয়ে অর্জন করতে হয় প্রতিদিনের লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত আমার কাছে অবশ্য দিনটি বিশেষভাবে কষ্টকর মনে হয়নি। তবে এভারেস্ট বেজক্যাম্প অথবা গোকিও ট্রেকের তুলনায় এই উচ্চতা তো কিছুই নয়।

প্রথমে ৪৫ মিনিট ধরে ক্রমাগত নামতেই থাকি। নামতে নামতে একেবারে নদীর কিনারে পৌঁছাই। কালী গণ্ডকী নদীর ওপর বেশ বড় একটা সাসপেনশন ব্রিজ। ইবিসির (এভারেস্ট বেজক্যাম্প) ব্রিজগুলোর তুলনায় এখানকার প্রায় সব ঝুলন্ত সেতু অনেকটা নিচের দিকে। ব্রিজ পার হয়ে দেড় ঘণ্টা খাড়া চড়াই বেয়ে পাহাড়ের উঁচুতে উঠে যেতে হয়। যে জায়গায় পৌঁছলাম, তার নাম আপার সিনুওয়া। এর পরের দেড় ঘণ্টা ধীর চড়াই, অপরূপ শ্যামল রঙের আপার মোদিখোলা উপত্যকার ভেতর দিয়ে ক্রমান্বয়ে উঁচুতে উঠে যাওয়া পথ ধরে চলতে হয়। একটা অংশে অরণ্য বেশ ঘন ও গভীর। ওক আর রডোডেনড্রন তো রয়েছেই; তার সঙ্গে আছে বেত ও বাঁশের ঘন বন। অনেকটা উঁচুতে উঠে তারপর আবার কিছুটা নেমে নদীর তীরে ব্যাম্বু নামের একটা ছোট জায়গায় এলাম। দুপুরের খাবারের জন্য জায়গাটা দুর্দান্ত। এবারের যাত্রায় রাতে ডাল–ভাত অথবা ডিমের ঝোল আর ভাত খেলেও দুপুরে আমি একটা স্যুপ ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, অথবা মোমো খেতে চেষ্টা করি।

আরও পড়ুন
এটা শুধু নদী নয়, এবিসির দিকে হেঁটে চলার পথ
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এদিককার পাহাড়ে পাইনবন নেই। আমাদের যাত্রাপথের প্রথম দিকে পাহাড়ি অরণ্যে অন্য নানা ধরনের গাছ দেখেছি। কোনো কোনো জায়গায় পথের পাশে আছে লাল রডোডেনড্রন। আগেই তেজ বলেছিল, মে মাসের এই সময়ে বসন্ত শেষ হয়ে আসছে, বেশির ভাগ গাছের ফুল ঝরে গিয়েছে। তবু দু-একটা জায়গায় দেখতে পাই, লাল ফুলে ছেয়ে আছে গাছের শাখা আর ঝরে পড়া ফুল দিয়ে লাল হয়ে আছে ট্রেকিংয়ের পথ। আমি বারবার রডোডেনড্রন ফুলের কথা জিজ্ঞাসা করি বলে তেজ এ রকম কোনো কোনো জায়গা পার হওয়ার সময় দূর থেকেই আমার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দেয়। ব্যাম্বুর আগে ও পরে চারদিকে দেখি বেতবন আর বাঁশঝাড়। পাহাড়ের গায়ে দু-তিন প্রজাতির নানা আকারের বাঁশ। বেতগুলো সরু। বেশির ভাগ বাঁশ হাতের আঙুলের মতো বা তার চেয়ে সামান্য মোটা। পার্বত্য পথের কোনো কোনো জনপদে লজের পাশে এসব বাঁশ নানা রকম কাজে ব্যবহৃত হতে দেখি। আঙুলের মতো মোটা বাঁশ দিয়ে ট্রেকিং পোল বা লাঠি তৈরি হয়। সেগুলো স্থানীয় লোকজন যেমন ব্যবহার করেন, তেমনি বিদেশিদেরও দেওয়া হয়।

এখান থেকে দেড় ঘণ্টার ট্রেক সেরে আমরা পৌঁছই দোভান। সেই পথের একটা জায়গায় হঠাৎ দেখতে পাই বিশাল একটা ধূসর লেঙ্গুর। এদেরই সম্ভবত হনুমান বলে। বাঁ পাশের পাহাড় থেকে লাফিয়ে নেমে আমাদের ঠিক সামনে পথের ওপর দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ হেঁটে তারপর লাফ দিয়ে ডান দিকের খাদে ঝোপের আড়ালে চলে যায়।

আরও পড়ুন

এই পথে দুপাশেই ছোট-বড় অসংখ্য ঝরনা আছে। পাহাড়ের উঁচু থেকে সেই ঝরনার জল ঝিরঝির শব্দ তুলে নেমে আসছে। কোথাও জলের ধারা ক্ষীণ, তার শব্দও কম। কোথাও বেশ বড়সড় ও স্ফীত জলধারা কলস্বর তুলে নেমে আসে। অনেক দূর থেকে সেই শব্দ শুনে বুঝতে পারি, আমরা ঝরনার কাছাকাছি এসেছি। কখনো আবার পাহাড়ি বর্ষণের ঢল নিয়ে গর্জন তুলে নিচের দিকে নেমে আসে ঝরনাগুলো। পথের একটা অংশ ভাসিয়ে দিয়ে পাথর ডিঙিয়ে জল গড়িয়ে চলে যায় অন্যদিকে আর তারপর সগর্জন ঝাঁপিয়ে পড়ে আরও নিচের দিকে, খাদের গভীরে। নিচে গিয়ে মিশে যায় কোনো চেনা বা অচেনা নদীর স্রোতের সঙ্গে।

দোভান থেকে বের হয়ে পরের দেড় ঘণ্টা অনেকটা চড়াই পথে হাঁটতে হয়। কঠিন ট্রেক শেষ করে আমরা পৌঁছই আমাদের আজকের গন্তব্য হিমালয়াতে। এই পথে পাশের উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা অসংখ্য ঝরনা রয়েছে। একটা জায়গায় ডান দিকের খাদ ও নদীর অপর পাড়ে রয়েছে বড় একটা পাহাড়, যার বিভিন্ন অংশ থেকে পাথরের গা বেয়ে নেমে এসেছে আলাদা আলাদা অন্তত ১৫টি ঝরনাধারা।

আরও পড়ুন

এখানে ট্রেকিং পথের মাঝখানেই নতুন একটা বৌদ্ধমন্দির গড়ে তোলা হয়েছে। এখনো তার নির্মাণকাজ, বিশেষ করে চারপাশের সাজসজ্জা শেষ হয়নি। অন্নপূর্ণা অভয়ারণ্য, যাকে এখন বলা হয় অন্নপূর্ণা সংরক্ষিত এলাকা প্রকল্প, নানা কারণে এখানকার আদিবাসী, বিশেষত গুরুং সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে নানা রকম বিধিনিষেধ রয়েছে। আগের তুলনায় কিছু নিষেধ শিথিল হয়েছে। তবে এখনো এখানে মাছ ও মুরগি রান্না করা বা খাওয়া নিষেধ। কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো নিষেধ, কোনো কোনো পাহাড়ের শিখরে ওঠা নিষেধ। নানা দেশ থেকে আসা ট্রেকারদের এ বিষয়ে জানিয়ে দেন স্থানীয় গাইডরা, যাতে সবাই স্থানীয় রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারেন।

হিমালয়া হোটেল ২ হাজার ৯২০ মিটার বা ৯ হাজার ৫৭৮ ফুট উচ্চতায়। ট্রিলাইন পুরোপুরি পেরিয়ে আসিনি, তবে এখানে আর বড় কোনো গাছ নেই। চারদিকে ছোট ছোট পাহাড়ি ঝোপঝাড় ও নানা রকম ঘাস আছে। হিমেল বাতাসে জায়গাটা প্রচণ্ড ঠান্ডা। বিকেলেই তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি। সন্ধ্যায় ক্রমেই শীত বাড়ে, বাইরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যাচ্ছে। এখানকার রুমগুলোর প্রতিটিতে সরু সরু তিনটি করে দোতলা বিছানা। প্রতিটি ঘরে ছয়জনের শোয়ার ব্যবস্থা। দূরে আলাদা বাথরুম।

আরও পড়ুন
পাহাড়ি পথে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এদের ডাইনিংরুমে নানা দেশের অনেক অতিথি একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করছেন। কিছুক্ষণ আগে পথে যে মালয়েশীয় ট্রেকারদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তাঁরাও এখানে আছেন। আছেন বেশ কজন ভারতীয় ও নেপালি তরুণ। ইউরোপীয় আছেন কয়েকজন। সবাই ডাল–ভাত খাচ্ছেন। একজন ভাতের বাটি নিয়ে ঘুরে ঘুরে সবাইকে জিজ্ঞাসা করছেন, আরও চাই কি না। বেলজিয়ান এক তরুণ কয়েকবার করে নিলেন সেই ভাত আর ডাল। এই তরুণের ডাল-ভাত খাওয়া আমি মুগ্ধ চোখে দেখি। আমি আজ নিয়েছি ডিম-ভাত। সেদ্ধ ডিম রান্না এমনিতেই আমার প্রিয় খাবার। তবে শুধু ডিমের ঝোল আর ভাত যে এত সুস্বাদু হতে পারে, আমার জানা ছিল না।

হিমালয়া হোটেলে শুধু এই খাওয়ার ঘরে ওয়াই–ফাই আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে কিছুক্ষণ হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ই-মেইল—এসব দেখি। এখানেই আমার ফোন চার্জ করে নিই, কারণ রুমে সে ব্যবস্থা নেই। প্রতি রাতের মতো আজও তেজ এসে বলে যায় কাল কখন শুরু করব, কোথায় যাব, কেমন হবে ট্রেকিংয়ের পথ, আর আমাদের করণীয় কী কী। এরপর গাইড ও পোর্টারদের খাবার দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর খালি হতে শুরু করে। মনে হয়, আমরা যার যার রুমে চলে যাওয়ার পর এ ঘরেও কেউ কেউ ঘুমাবে। বাইরে ঠান্ডার তীব্রতা বাড়ছে। তাই আমিও তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।