প্রথম দিনের ট্রেকে অনন্য সহযাত্রী
নেপালের পোখারা থেকে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প—সব মিলিয়ে ১০ দিনের ট্রেক। পথটা দুর্গম, তবে অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। হিমালয়ের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ভুলিয়ে রাখে গন্তব্যে পৌঁছার কষ্ট। যেতে যেতে আরও কত কি যে চাক্ষুষ হয়! মে মাসে পার্বত্য এই পথেই হেঁটে এসেছেন ইফতেখারুল ইসলাম। সেই অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব
পোখারা এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিদ্যুচ্চালিত উজ্জ্বল নীল সুন্দর একটা টাটা টিগর গাড়ি এসেছে। গাড়ির ভেতরটাও পরিচ্ছন্ন। তরুণ চালক বেশ স্মার্ট—গাড়িটার প্রশংসা করায় তিনি খুশি। জানালেন, নেপালে এ রকম বৈদ্যুতিক গাড়ি আরও কিছু কিছু এখন আসছে।
বাটিকা হোটেলে পৌঁছেই তেজের সঙ্গে ঠিক করে নিই, ফেওয়া লেকের পাশে হেঁটে বিকেলটা কাটাব। বিকেলের আকাশ মেঘলা। তাই মচ্ছপুছারে বা দূরের আর কোনো পাহাড় দেখা গেল না। তবে লেক আর তার বুকে রঙিন নৌকাগুলো সব সময় যেমন সুন্দর দেখায়, আজও তেমনই আছে। এখানেও বেশ শীত শীত ভাব। কাজেই ফ্লিসের জামা আর জ্যাকেট আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। হোটেলে ফিরে সন্ধ্যায় ডিনার সেরে কিছুক্ষণ বই পড়ে সময়মতো ঘুমাতে যাই। পরদিন ভোর ছয়টায় উঠতে হবে, সাড়ে ছয়টায় ব্রেকফাস্ট।
৪ মে সকাল ঠিক সোয়া সাতটায় আমরা গাড়িতে করে নয়াপুল রওনা হলাম। গাড়িতে তেজ ছাড়াও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আমাদের পোর্টার ভরত। আগে তাকে আমি একবার পোর্টার আর একবার বড় দলের সঙ্গে সহকারী গাইড হিসেবে পেয়েছি। নয়াপুল ছাড়িয়ে আর একটু সামনে বিরেটহাটি নামের একটা জায়গাতে আমরা গাড়ি ছেড়ে ট্রেক করতে শুরু করি। এ জায়গাটা আমার চেনা। কারণ, এখান থেকেই আমরা আগের বছর ঘোরেপানি-পুনহিল ট্রেক শুরু করেছিলাম।
নীল আকাশে অল্প অল্প মেঘ, কখনো রোদ, কখনো ছায়া। এমন একটা সুন্দর সকালে শুরু হয় আমার ট্রেকিং। এক ঘণ্টায় আমরা শাউলি বাজার পৌঁছাব। আমাদের ডান দিকে নিচে শ্বেতী নদী। বাঁ দিকে পাহাড়। এই পথটুকু ট্রেকিংয়ের জন্য সহজ। শাউলি বাজারে পৌঁছে কফি খাই। বিরতির পর ট্রেক শুরু করতেই খাঁড়া চড়াই ধরে উঠতে হয়। এখানে কিছু কিছু অংশে গাড়ি চলার মতো রাস্তাও আছে। আমরা সেই রাস্তা ধরে কিছুটা হেঁটে এসেছি। এখন উঁচুতে উঠে বিকল্প পথ, মানে শুধু ট্রেকিংয়ের পথ বেছে নিই।
পথে জার্মানি থেকে আসা তরুণী মালিনের সঙ্গে দেখা। দেখতে বড়সড়, মানে উচ্চতায় আমার চেয়েও খানিকটা বড়, সদ্য আন্ডারগ্র্যাড করে আসা এই তরুণী কয়েক মাস ধরে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে নেপালে এসেছে। এই সলো ট্রাভেলার বা একাকী ভ্রামণিক একজন গাইড নিয়ে এখন চলেছে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পের উদ্দেশে। এটাই তার প্রথম ট্রেক।
আমরা যে যার গতিতে হাঁটলেও একটু পর কিমচে নামের একটা জায়গায় পথের পাশে ছোট্ট একটা লজের খোলা চত্বরে মালিনের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায়। আমিও লাঞ্চের জন্য এখানেই বিরতি নিই। কিমচে গেস্টহাউসে একটা স্যুপ আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অর্ডার দিয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনেকক্ষণ। এ সময় মালিন আর আমি উঠে গিয়ে বেশ কয়েকটা ছবি তুলি। সপ্রতিভ মেয়েটি খুব আন্তরিকভাবে ওর এবারের ভ্রমণের গল্প বলে। প্রাথমিক শিক্ষকতা বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর ওর এখনকার পরিকল্পনার কথা শুনি। এই ভ্রমণ সেরে ফিরে গিয়ে ও মাস্টার্স করবে। তারপর দেড় বছরের ইন্টার্নশিপ শেষ করে সে হবে প্রাথমিকের একজন শিক্ষক।
ছাত্রজীবনের মাঝপর্যায়ে এ রকম একটা লম্বা ভ্রমণের অনুপ্রেরণা সে তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। মা নিজেও গ্র্যাজুয়েশনের পর এ রকম বেড়াতে বের হয়েছিলেন। মা আছেন না নেই, তা বুঝতে পারি না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার বালি ভ্রমণ করার ব্যাপারে তাকে উৎসাহ দিয়েছেন অন্য এক নারী। ওর ভাষায় ওর ড্যাডস গার্লফ্রেন্ড। জানতে চাই, বালির কোন কোন সৈকতে গিয়েছ, সব মিলিয়ে বালি কেমন লাগল? সে বলে, বালি দ্বীপটি তো খুবই চমৎকার, তবে কোনো কিছুই আগের মতো নেই। আগে ওই দ্বীপ কেমন ছিল, তা সে জানল কী করে? সেটাও ওর ড্যাডস গার্লফ্রেন্ড বলেছেন। মালিন তার দেখা বালির বিবরণ লিখে জানিয়েছে ওই ভদ্রমহিলাকে। তিনি খুবই মর্মাহত হয়েছেন। আগে বালি কত সুন্দর, অমলিন ও নৈসর্গিক ছিল, সেসব কথা লিখেছেন। আমি ওর গল্প শুনি আর একটু একটু হাসি। আরও কয়েকবার তার ড্যাডস গার্লফ্রেন্ডের কথা শোনার পর আমি সতর্কভাবে জানতে চাইলাম, তোমার বাবার বান্ধবীর সঙ্গে তোমার কি খুবই ঘনিষ্ঠতা? সে বিনা দ্বিধায় বলে, হ্যাঁ, খুবই। সম্ভবত বাবার চেয়েও তাঁরই সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেশি।
অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণে যে একাকী নারীরা হিমালয়ে বা অন্যত্র পথ চলেন, তাঁদের অনেকেই যেমন মানসিকভাবে অদম্য ও স্বাধীনচেতা, তেমনি নানামুখী সৃজনশীলতার চর্চায় আগ্রহী। আমাদের দেশের যে নারীরা পর্বতারোহণ, ট্রেকিং, দৌড়, ম্যারাথন, সাইক্লিং, ইত্যাদির চর্চা করেন, তাঁদের মধ্যেও এমন গুণাবলি রয়েছে। মালিন প্রতিভাবান বালিকা। নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসে। সলো ট্রাভেল করতে চায়, ভারতে ও বাংলাদেশে সেটা সম্ভব কি না তা নিয়ে আলোচনা করে। সে ছবি তোলে, নিজে ছবি আঁকে। যেখানে যায়, সেখানকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অনেক কিছুর ছবি এঁকে রাখে। প্রতিদিনের ভ্রমণের সব খুঁটিনাটি নোট লিখে রাখে, এবং...। এবং মালিন কবিতা লেখে।
এখানে আসার আগে সে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে গিয়েছে। কোথাও তাড়াহুড়া করে না। ওখানে এক বা দুই সপ্তাহের একটা মেডিটেশন করেছে। ইতিমধ্যে তার ভেতরে সূচিত হয়েছে কিছু পরিবর্তন। কিছু ভাবনা ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠছে। আগে সে বেশির ভাগ জিনিস লিখত প্রকাশ করার জন্য। কিছু ছবি সে দিত ইনস্টাগ্রামে। এখন তার মনে হয়, অন্যকে পড়তে দেওয়ার জন্য লিখলে বা অন্যদের দেখানোর জন্য ছবি আঁকলে তার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় অন্যদের মনমতো হওয়া। প্রশংসিত হওয়া। চেষ্টা করতে হয় যেন তা অন্যদের কাছে ভালো লাগে, অন্যদের চোখে সুন্দর দেখায়। কোথাও পোস্ট না করে, শেয়ার না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে যা লিখবে তা হবে শুধু নিজের জন্য লেখা। স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। এখন ওর স্বাভাবিক চিন্তা, লেখা ও ছবি কোনো কৃত্রিমতা বা প্রসাধন ছাড়া বাধাহীনভাবে রচিত হতে পারছে। এই তো ভালো। বালিকার ব্যতিক্রমী ভাবনা ও তার স্পষ্ট উচ্চারণ শুনে এই প্রজন্মের ছোটদের সম্পর্কে আশান্বিত বোধ করি।