এখানে কেনাবেচার কাজে নারীর অংশগ্রহণ ও কর্তৃত্ব অনেক বেশি

আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে উঁচু পর্বত কিলিমানজারোতে গিয়েছিলেন ইফতেখারুল ইসলাম। পর্বত আরোহণ ছাড়াও তানজানিয়ায় জাতীয় উদ্যানে সাফারি করেছেন তিনি। এ সফরের গল্প নিয়েই আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি।

ট্রেক শুরু করার আগে দলের সদস্যরাছবি: ইফতেখারুল ইসলামের সৌজন্যে

মার্চ-এপ্রিল মাসে একে একে আরও অনেকেই আমাদের দলে যোগ দেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করে আমরা তাতে যুক্ত হই। এ দলের প্রত্যেকেই আগে কোনো না কোনো অভিযানে গেছেন। পর্বতে, গিরিপথে, অ্যান্টার্কটিকায় অথবা মরু ও মেরুতে গেছেন অনেকে। দলের বেশির ভাগই তরুণ অথবা মাঝবয়সী।

কিলিমানজারো অভিযানের প্রস্তুতি বিষয়ে নানা রকম প্রশ্ন করেন সবাই। ট্রেকের খরচ, পেমেন্ট পদ্ধতি, তানজানিয়ার ভিসা, ট্রেকের প্রস্তুতি, পার্বত্য পথে থাকা খাওয়া, ট্রেকের আগে বা পরে আর কী কী করা যেতে পারে—এ রকম নানা প্রশ্ন।

তারেক অণু তার উত্তর দেয়। কেউ পরে যোগ দিলে আগের মেসেজগুলো পড়তে পারেন না। পুরোনো প্রশ্ন নতুন করে করেন। আমি নিজেও অনেক অনাবশ্যক প্রশ্ন করি। অণু ধৈর্য ধরে উত্তর দেয়। অথবা আমাদের এজেন্সি কিলিগ্লেসিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে উত্তর জেনে নেয়।

শতাব্দীপ্রাচীন বাওবাব গাছ
ছবি: ইফতেখারুল ইসলামের সৌজন্যে

আমরা দল বেঁধে জুম মিটিং করি। একপর্যায়ে আমাদের ট্রেকিং এজেন্সির ডেনিস আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। আমাদের নানা রকম প্রশ্নের উত্তর পাই। এজেন্সির আমন্ত্রণপত্র, হোটেল বুকিং, ইত্যাদি সংগ্রহ করে নিয়ে অনলাইনে ভিসা ফি জমা দিয়ে তানজানিয়ার ভিসার আবেদন করি।

পদ্ধতিটা তেমন জটিল কিছু নয়। কয়েক সপ্তাহ পর একজন একজন করে ই-মেইলে ভিসা পেতে শুরু করি আমরা। একজন ভিসা পেলে অন্যরা সে খবর শুনে খুশি হই। নিজের ভিসার জন্য উত্কণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের সবার ভিসা হয়ে যায়। ঢাকার একটা ক্লিনিক থেকে ইয়েলো ফিভারের টিকা নিতে হয়।

বাংলাদেশি অভিযাত্রীদের এই দলের অনেকেই দেশে থাকেন। বেশির ভাগ ঢাকায় থাকলেও একজন থাকেন গাজীপুরে, একজন দিনাজপুরে, একজন কক্সবাজারে। এ ছাড়া আমাদের দলের বেশ কজন রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।

সেখান থেকেই তাঁরা আসবেন তানজানিয়ায়। একজন আসবেন ওমান থেকে, দুজন সিঙ্গাপুর থেকে। কেউ আগে পৌঁছে অন্য শহর ঘুরেফিরে দেখবেন। কেউ ট্রেক সেরে তারপর যাবেন অরণ্যভ্রমণে। সেই দলে আমিও যোগ দেব। ভিসার জন্য আবেদন করার পর আমরা সবাই যার যার মতো বিমান টিকিট কিনে ফেলতে চেষ্টা করি।

আমি কিনি ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের টিকিট। ঢাকা থেকে আদ্দিস আবাবা। সেখান থেকে কিলিমানজারো। অর্থাৎ আমার দার এস সালাম বা জাঞ্জিবার যাওয়ার প্ল্যান নেই। পর্বত অভিযান শেষ করে তারপর সাফারি। পরে সম্ভব হলে অন্য কিছু করব।

ইথিওপিয়ান এয়ারে আগে ওঠা হয়নি

পেছনে বারাংকো ওয়াল
ছবি: ইফতেখারুল ইসলামের সৌজন্যে

গত ২৫ জুলাই ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ধরার জন্য দুপুরে ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখলাম এদের চেক-ইনের প্রক্রিয়ায় দুটি বাড়তি পদক্ষেপ আছে। অল্প দিন হলো এরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছে। তাই ইথিওপিয়ান এয়ারে আমার এর আগে ওঠা হয়নি। চেক-ইন ও ইমিগ্রেশন সেরে দেখি অনেকটা সময় আছে হাতে।

ওপরতলায় লাউঞ্জে কিছুটা সময় কাটিয়ে তারপর চলে যাই বোর্ডিং গেটে। সেখানে একে একে এসে পৌঁছান আমিন ভাই, ওয়াসিক, তিন্নি, জুঁই, লিজা ও জাকির। আমরা ঢাকা থেকে এক ফ্লাইটে যাত্রা করলেও একসঙ্গে সবাই মোশি যাচ্ছি না।

ট্রেক শুরুর আগের দুটো দিন একেকজনের একেক রকম প্ল্যান। শুধু আমিই আদ্দিস আবাবা থেকে পরদিন সরাসরি কিলিমানজারো যাচ্ছি।

প্লেনে ওঠার আগে সবাই মিলে সেলফি তুললাম। আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সেই ছবি পোস্ট করে সবাইকে জানান দেওয়া হলো—আমরা আসছি। কতবার কত কাজে একা অথবা অন্যদের সঙ্গে প্লেনে যাত্রা করেছি।

তার চেয়ে আজকের ভ্রমণ অনেক অন্য রকম। কিলিমানজারো অভিযান ও আফ্রিকা ভ্রমণ শুরুর উত্তেজনা ও আনন্দ ছড়িয়ে আছে আমাদের ছোট-বড় সবার চোখে-মুখে, হাসিতে ও কথায়। একজনের ভ্রমণ-গল্পে এ রকম সবার অনুভূতি ধারণ করা কঠিন। তবু আমি অন্য সবার মুখের দিকে উত্সুক হয়ে তাকিয়ে থাকি।

ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে রাতে আদ্দিস আবাবা পৌঁছাই। সেখানে এয়ারলাইনসের আতিথেয়তায় রাত্রিবাসের ব্যবস্থা নিখুঁত। এয়ারপোর্ট থেকে মিনিবাসে করে ওরা ওদের হোটেলে নিয়ে যায়। চমত্কার রুম।

রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার ও পরের দিনের ব্রেকফাস্টের পরিপাটি আয়োজন। পরদিন খুব সকালে নাশতা সেরে এয়ারপোর্টে গিয়ে ফ্লাইট ধরি। একটু পরে প্লেন থেকে দেখি উজ্জ্বল নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর তার ওপরে মাথা তুলে দাঁড়ানো কিলিমানজারো পর্বতশিখর। এই ফ্লাইট দুই ঘণ্টা পরেই নিচে নামতে শুরু করে।

উড়োজাহাজের জানালা দিয়ে দেখা কিলিমানজারো
ছবি: ইফতেখারুল ইসলামের সৌজন্যে

শান্ত ছোট্ট একটা বিমানবন্দর। প্লেন থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে টার্মিনাল ভবনে ঢোকার আগেই ইয়েলো ফিভার টিকার কাগজ দেখাতে হয়। তারপর ইমিগ্রেশন। এ দেশে ভিসা ও অন্যান্য কাগজপত্র থাকলেও বাংলাদেশি যাত্রীদের খানিকটা সতর্ক চোখে দেখা হয় বলে শুনেছি।

আমাদের দলের কাউকে কাউকে ইমিগ্রেশনে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে। আমি সে রকম কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হইনি। হয়তো বয়স কখনো কখনো সহায়ক হয়। দ্রুত সব কাজ সেরে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসি। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই দেখা হয় ডেনিস ও হাফিজের সঙ্গে। এসে গেছি। আফ্রিকার এই দেশে প্রথম পা রেখে ওদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় খুশি হয়ে উঠি।

এয়ারপোর্টেই অল্প কিছু ডলার ভাঙিয়ে স্থানীয় মুদ্রা নিলাম। লাখ লাখ টাকায় পকেট ভরে যায়। মোবাইল ফোনে স্থানীয় সিম নিতে গিয়ে একটু দেরি হয়।

কাউন্টারে ভিড় না থাকলেও এখানকার কাজে সময় লাগে। কাজ সেরে ওদের সঙ্গে রওনা হই মোশির পথে। সেটা একটা আলাদা শহর। হোটেলে পৌঁছাতে এক ঘণ্টা লাগবে, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আমরা গাড়িতে বসে নানা বিষয়ে গল্প করি, আমাদের কোনো তাড়া নেই। হাইওয়ে খুব প্রশস্ত নয়।

কিছু দূর পরপর পথের ধরে ছোট বাজার। কোথাও সবজি বিক্রি হচ্ছে, কোথাও ফল। বড় বড় বস্তা ও ঝুড়িতে করে সেসব চালান হয়ে যাচ্ছে দূরের কোনো শহরে অথবা বন্দরে। নানা রকম আলু ও টমেটো হয় অনেক। কলা আছে, কমলা আছে।

আর আছে প্রচুর অ্যাভোকাডো। একটা জায়গায় ডেনিস গাড়ি থামিয়ে অন্য কারও সঙ্গে দেখা করতে যায়। হাফিজকে বলে আমাকে নিয়ে জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাতে।

পণ্য কিছুটা আলাদা হলেও হাইওয়ের পাশের এই বাজারের চেহারা ও কর্মকাণ্ড আমাদের দেশের মতোই। শুধু দোকান চালানো ও পণ্য কেনাবেচার কাজে নারীর অংশগ্রহণ ও কর্তৃত্ব অনেক বেশি। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছাই মোশি শহরে। শহরের এক প্রান্তে আমাদের নির্ধারিত হোটেলে। (চলবে)

আরও পড়ুন