এখানে বব মার্লে মোনালিসার প্রতিবেশী

নেপালের মাসট্যাং জেলার মুক্তিনাথে একটা হোটেল আছে, নাম ‘বব মার্লে’! মুক্তিনাথ নেপালের ধর্মীয় পীঠস্থান। হিন্দু–বৌদ্ধ উভয় ধর্মাবলম্বীরা এখানে আসেন। আছে হিন্দু মন্দির এবং একটি বৌদ্ধ মঠ। মুক্তিনাথের জিরো কিলোমিটার থেকে মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে হোটেলের দেখা মেলে। আর এটার পাশেই যে হোটেলটা, সেটার নাম ‘মোনালিসা’! তাহলে বলুন, বব মার্লে আর মোনালিসা এখানে প্রতিবেশীই কি না?

বব মার্লে হোটেলের পাশে আছে মোনালিসা নামে আরেকটি হোটেলছবি: লেখকের সৌজন্যে

সবে মার্ফা গ্রাম থেকে ফিরেছি। মুক্তিনাথ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য গাড়ি পেতে একটু ধকল পোহাতে হয়েছে। মুক্তিনাথে সবাই যান পুণ্যলাভের আশায়। অনেকে আবার বলেন, মুক্তিনাথের যে জলাধার, তাতে ডুব দিলে ধুয়ে যায় আগের সব পাপ। আমি এসেছিলাম আত্মাকে মুক্ত করতে।
আচ্ছা! এবারে আসা যাক হোটেলটার গল্পে। মন্দিরের দিকে হাঁটছিলাম। প্রথমেই চোখ পড়ল বব মার্লের ছবিতে। একটু থমকে দাঁড়ালাম। নাম দেখলাম ‘হোটেল বব মার্লে’। কৌতূহল হলো। সেদিন রাতে মুক্তিনাথে থাকার পরিকল্পনা ছিল না। ভেবেছিলাম, একটু এগিয়ে গিয়ে জমসম নামের ছোট্ট মফস্‌সল শহরটায় থাকব। পরদিন সকালের বাসে পোখারা। কিন্তু হোটেলটা দেখেই মনে হলো, নাহ্‌, এখানেই থাকতে চাই। সঙ্গে দোতলায় যে ক্যাফেটা, সেটার নাম আবার ‘ফ্রিডম ক্যাফে’। মানে আমাকে আটকে রাখার সব আয়োজনই ছিল। উঁকি মারলাম একবার। কাউকে পেলাম না। কাঠের তিনতলা হোটেল। দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পেলাম না। কেউ নেই।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করার উপায় ছিল না। ভাগের ট্যাক্সিতে এসেছি। ট্যাক্সিচালক বলেছেন ফিরতি পথে যাত্রী নেই। আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। তাই বের হয়ে পা চালালাম দ্রুত। মিনিট চল্লিশেক লাগবে মুক্তিনাথের মন্দিরটায় পৌঁছাতে। আশপাশে দুই ধারে বরফ জমে আছে তখনো। বরফগলা পানি গড়িয়ে নিচে পড়ছে। এখান থেকে ধলাগিরি খুব একটা দূরে নয়। চারপাশে সাদা পাহাড় মাথা উঁচু করে আছে। ডিসেম্বরের শেষ তখন। আরেকটু বরফ পাব আশা করেছিলাম। তবে হিমেল হাওয়া বয়ে চলছে। মন্দির আর মঠের আশপাশে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে ফিরছিলাম। চালক বলেছিলেন, তিন ঘণ্টার বেশি দেরি না করতে। মন্দিরের বিশাল সিঁড়ি বেয়ে নেমে মিনিট দুই এগিয়েছি, দেখা হলো এক রুশ ভদ্রলোকের সঙ্গে। আগের দিন বাসে আমার সহযাত্রী ছিলেন। ইংরেজি ভালো বলতে পারেন না, তাই চুপচাপ থাকেন বেশির ভাগ সময়। বাস পথে একটা ঝরনার ধারে থেমেছিল। ভদ্রলোক একা একা ছবি তোলার চেষ্টা করছিলেন। বললাম, ‘আমি তুলে দিচ্ছি।’ তখনই যা একটু আলাপ। এরপর মারফাতে নেমে গেলাম। সবাই চলে গেল জমসম। এবার আমাকে দেখে তাঁর চোখের মণি উজ্জ্বল হলো। হাসলেন একটু। বললেন, উঠেছেন সেই বব মার্লেতে। সেখানে নাকি থাকার খরচ নেই! শুধু খাবার খরচটাই দিতে হয়। আমার আগ্রহ আরেকটু বাড়ল এবার। ঘটনাটা কী?

খাওয়ার সঙ্গে থাকা ফ্রি

নাম দেখেই হোটেলে একরাত থাকার ইচ্ছে হলো
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ফেরার পথে আবার উঁকি দিলাম। এবার একজনকে পাওয়া গেল। বললেন, তিনিই মালিক হোটেলের। নাম কারমা। বাংলায় যেটা ‘কর্ম’। জানতে চাইলাম, থাকার রুম মিলবে কি না। জানালেন, মিলবে, লাক্সারি ও সাধারণ—দুটোই আছে। লাক্সারিগুলো নেপালি ছয় হাজার রুপি। আমার সেটা দরকার ছিল না। সাধারণটাই চাইলাম। বললেন, ‘তুমি দুইভাবে নিতে পারো। যদি এখানে খাবার খাও, তাহলে ভাড়া ৫০০ রুপি। আর যদি বাইরে খাও, তাহলে দেড় হাজার।’
খটকা লাগল। একটু আগে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলল না। বললাম, ‘চমৎকার! কিন্তু এমন নিয়ম কেন?’
‘এই খাবারটা থেকেই আমাদের যা একটু লাভ হয়। থাকার লোক তো আসে–যায়!’ (পরদিন অবশ্য নিয়মটা বলে দিয়েছিলেন একজন হোটেলবয়। এখানে তিন বেলা খাবার খেলে থাকার খরচ দিতে হয় না, বিষয়টা এ রকম।)
‘এই হোটেলটার নাম বব মার্লে কেন?’
‘সে বহু বছর আগে আমার পূর্বপুরুষদের সময়ে বব মার্লে এখানে এসেছিলেন। কয়েক দিন ছিলেন। তাঁর স্মৃতিতেই হোটেলের নাম বব মার্লে।’
আমি তো ঠিক করেই ফেলেছি এই হোটেলে থাকব। তাই আর কথা বাড়ালাম না। জানালাম, এখানেই খাব। এরপর চটজলদি এগিয়ে ট্যাক্সি বিদায় করতে গেলাম। ব্যাগটা গাড়িতেই রেখে এসেছিলাম। গিয়ে বললাম, ‘আজ ফিরছি না।’
মন খারাপ করলেন বেচারা চালক। বললেন, ‘তোমাকে কথা দিয়েছি, তাই দুজন যাত্রীকে মানা করে দিলাম একটু আগে।’
‘আচ্ছা! সমস্যা নেই। তুমি সাবধানে থাকো। আমারও খারাপ লাগল। সরি!’
হাতে ২০০ টাকা গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘এটা রাখো। কিছু মনে কোরো না। আমার আজ রাতটা এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে।’

আরও পড়ুন

ফায়ারপ্লেসে আড্ডা

হোটেলের অতিথিদের জন্য রাখা আছে বই
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এরপর ফিরলাম হোটেলে। সেই সাতসকালে নাশতা করে বেরিয়েছি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। নিচে একটা বিশাল ফায়ারপ্লেস। চারপাশে বসার জায়গা করে দেওয়া। বললাম, ‘কিছু দিতে পারবে এখন? খুব ক্ষুধা পেয়েছে।’
মেনু এল। একটা অ্যাপল পাই, সঙ্গে একটা লেমন–টি দিতে বললাম। এক ফাঁকে ওপরে ব্যাগ রেখে এলাম। কারমা এলেন সঙ্গে। বললাম, ‘পাহাড় দেখতে পাব, এমন রুম নেই?’
বললেন, ‘আছে। চলো, নিয়ে যাচ্ছি।’
এবারের রুমটা বেশ। জানালার বাইরে সন্ধ্যা নামছে তখন। সাদা বরফের গা ছুঁয়ে আছে লালচে আভা।
ব্যাগ রেখে নিচে নেমে এলাম। চুল্লিতে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। একটু পর এল অ্যাপল পাই। খারাপ না খেতে। পেটের ডাকাডাকি তো বন্ধ হলো! ঠান্ডা বাড়ছে ধীরে ধীরে। পুরোটা হোটেল ঘুরে দেখলাম। এখানে–ওখানে মার্লে হেসেই চলেছেন ফটো ফ্রেমের ভেতর থেকে। নিচের বড় ঘরটার এক কোণে বেশ কিছু বই রাখা। অতিথিরা নিয়ে গিয়ে পড়তে পারবেন। পাশে ছোট্ট একটা বার আর একটা কফিশপও আছে। সোজা এগোলে আরও কিছু কক্ষ। বাইরের সিমেন্টের পরত আর রং এমনভাবে করা, মনে হচ্ছে কাদামাটি লেপে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মাটির ঘরগুলোর মতো। কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব এনে দিল। পুরো হোটেলটাতেই অ্যান্টিক একটা লুক। স্নানঘর আর টয়লেট কমন। রুমের সঙ্গে লাগোয়া নয়। হোটেলের লোকেরা জানালেন, স্নানঘরে গরম পানি পাব। কিন্তু টয়লেটে গরম পানি মিলবে না। আর খাওয়ার জন্যও গরম পানি লাগলে চেয়ে নিতে হবে। দোতলায় একপাশে রান্নাঘর। আরেক পাশে একটা ছোট রুমের মতো। সোফা আর গদি পাতা আছে। চাইলে যে কেউ বসে আড্ডা দিতে পারবে। দু–একটা থাকার রুমও আছে। আর সামনের দিকটায় খোলা বারান্দা। তাতে চেয়ার–টেবিল পাতা, বসে খাওয়ার জন্য। বিকেলে দেখেছিলাম বেশ জমজমাট আড্ডা বসেছিল।

আরও পড়ুন
সলো ট্রিপে মজা পেয়ে গেছি। তাই ঘুরতে ঘুরতে মুক্তিনাথ চলে এসেছি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ফিরে আবার ফায়ারপ্লেসের কাছে বসলাম। ততক্ষণে দেখলাম, আরও দু–একজন এসেছেন। এক দম্পতি এসেছেন ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে মোটারসাইকেলে চেপে। এদিকে ঘুরে একদম রাজস্থান পর্যন্ত চলে যাবেন। পুরুষটির নোট জমানোর শখ। একটা বাংলাদেশি কাগুজে নোট চেয়ে নিলেন আমার কাছ থেকে। তাঁদের সঙ্গে গল্প করছিলাম, কোনায় বসে এক নারী সব শুনছিলেন। বাংলাদেশি শুনে যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে। বললেন, বাংলাদেশেই ছিলেন তাঁর বাপ-দাদারা। নিজে বাংলাদেশে আসেননি কখনো। আগে কলকাতায় ছিলেন, এখন স্বামীসহ বেঙ্গালুরুতেই থাকছেন। এরপর এলেন সোনালি কোঁকড়াচুলো এক তরুণী। অনেকটা লম্বা। বুঝতে পারলাম না কোন দেশি। খানিক বাদে নিজে থেকেই বললেন, স্পেন থেকে এসেছেন। কাজ করছিলেন ল্যাপটপে। সেখানেই আবার ঘাড় গুঁজলেন। আরেকজন ভদ্রলোক এলেন, তিনি একদম পুরোদস্তুর ভবঘুরে। পদব্রজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা দুজন সম্ভবত আগে থেকেই পরিচিত। নিজেরা গল্প করছেন টুকটাক। এর মধ্যে বাঙালি তরুণীর স্বামী চলে এসেছেন। তাঁরা এই হোটেলে ওঠেননি। হোটেলের সজ্জা দেখে, অনেকটা আমার মতোই, আগ্রহী হয়ে কফি খেতে এসেছেন। এই হলাম আমরা সাতজন। সেই শীত–সন্ধ্যার অচেনা পরিব্রাজক দল, যাদের ক্ষণিকের জন্য একই সুতায় গেঁথেছে বব মার্লে। এবারে আমরা তিন বাঙালি আলাপে মাতলাম। এই দম্পতি এসেছেন একটা ট্যুর কোম্পানি থেকে প্যাকেজ নিয়ে। কোম্পানিটিকে শাপশাপান্ত করেই চলেছেন ভদ্রলোক। একটা সুমো গাড়িতে কেবল তাঁরা দুজন। আরামসে ঘুরতে–ফিরতে চান। বছরের শেষ দিনে আসমানে উড়ে বেড়াতে চান, তাই বুদ্ধা এয়ারের একটা এয়ার প্যাকেজ নিয়েছেন, এটা এভারেস্টের চূড়া দেখিয়ে আনবে তাঁদের খুব কাছ থেকে। আমার খরচাপাতির বহর শুনে তাঁর মেজাজ আরও খারাপ হলো। বারবার বলছেন, আপনি খুব সস্তায় ঘুরছেন তো!

নেপালের ওই ট্রিপে নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বব মার্লের গান চলতে শুরু করেছে তখন পেছনে। খাবারের কথা বলেছি সবাই। ওখানে বসেই গল্প করতে করতে খাব, সে রকমই কথা হলো। শীত যেভাবে তরতরিয়ে বাড়ছে, চুল্লির আগুনের আঁচে আমরা সবাই পা মেলে বসেছি। এর মধ্যেই গপ্প চলছে পালা করে। শুনছি সবাই। বাইকার লোকটির ব্যবসাপাতি আছে, ইউটিউবারও। সবাই ‘হাই’ বলে দিলাম তাঁর ভিডিওতে। আর তাঁর সঙ্গিনী প্রযুক্তি পেশাজীবী। ঘরে বসেই কাজ করেন। তাই মাসখানেকের জন্য তাঁরা বেরিয়ে পড়তে পেরেছেন অনায়াসে।
বাঙালি বাবুমশাই আমাকে জানালেন, পোখারা পর্যন্ত চাইলে তাঁদের সঙ্গেই চলে যেতে পারি তাঁদের সুমোতে করে। রাজি হয়ে গেলাম, তবে বলে দিলাম, ভাড়া শেয়ার করব। বাসে এই রাস্তায় ফেরার চেয়ে সুমোতে ফিরে যাওয়া বেশ ভালো প্রস্তাব। তাঁরা উঠলেন এবার। তাঁদের হোটেলে ফিরবেন।

আরও পড়ুন

বিশ্বাসে মেলায় বস্তু

শীতের অনুষঙ্গ নিয়ে দোকান সাজিয়েছেন কেউ কেউ
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

রাত বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হিম। ফায়ারপ্লেসের আগুনেও একটু ভাটা পড়ে এসেছে। হোটেলে কেউ জেগে নেই আর আগুন উসকে দেওয়ার জন্য। কাঠের মজুত ফুরিয়ে আসছে। বাইকার দম্পতিও উঠলেন। সকালেই আবার বেরিয়ে পড়বেন।
ঠায় বসে রইলাম আমরা তিন দেশের তিনজন। কেউ কারও নামটাও জানি না। অথচ গল্প চলছে অনবরত। স্প্যানিশ নারীটি এবার বলতে শুরু করলেন। তিনি মুক্তিনাথে এসেছেন তৃতীয়বারের মতো। শেষবার এসেছিলেন বছর পাঁচেক আগে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা ডুব দিয়েছ তো মন্দিরের জলাধারে?’
আমরা দুজন প্রায় একসঙ্গে মজা করে বলে উঠলাম, ‘আমরা তো পাপী নই!’
এরপর তিনজন একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠলাম। স্প্যানিশ নারীটি আবার বললেন, ‘আসলে বিশ্বাসের জন্য নয়, একটা কাজ সম্পন্ন করা অর্থে। সবাই যেমন করে। আমি ডুব দিয়ে ওঠার পর মনে হলো হালকা হয়ে গেলাম। তোমরাও ট্রাই কোরো, দেখবে, ভালো লাগবে।’
এবার আমার কথা জানতে চাইলেন। বললাম, ‘সলো ট্রিপে মজা পেয়ে গেছি। তাই ঘুরতে ঘুরতে মুক্তিনাথ চলে এসেছি। কোনো আশা নেই, চাওয়া নেই। আত্মার মুক্তি হোক।’
‘তো কী মনে হলো? মুক্তি পেলে?’
‘এই যে একা বেরিয়ে পড়ি, তখন একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। প্রকৃতিকে এত নিবিড় আর কখনো মনে হয় না। একেও তো “মুক্তি” বলা যায়, তাই না? যেমন ধরো, গতবার মানালিতে গেলাম। জেসপার একটা মঠে গিয়ে খুব কাঁদতে ইচ্ছে হলো। কাঁদলাম। এটাও আমাকে হালকা করল। মুক্তি দিল অনেক জরা থেকে। বিধাতার কাছে আমি কী বলি?’
‘কী?’
‘বলি, মঙ্গল হোক! সব ভালো হোক। নিজের জন্য কিছু চাইতে পারি না। তোমার কী মনে হয়, তুমি মুক্তি পেয়েছ?’
‘নাহ্‌! পাইনি এখনো। তবে মুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছি।’

হোটেল ঘরে বব মার্লে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আড্ডার এই পর্যায়ে হাল ধরলেন সেই পদব্রজে আসা ভদ্রলোক। আমাকে বললেন, ‘তুমি কিন্তু ঠিকই বলেছ। আমিও যখন পথে নামি, মনে হয় একটু একটু করে ছড়িয়ে দিচ্ছি নিজেকে। একার পথ। কিন্তু ক্লান্তি নেই কোনো। চলছি একটা ঘোরে। মনে হয়, মুক্তি মিলছে আমার।’
স্প্যানিশ ভদ্রমহিলা বললেন, ‘দেখেছ, এ জন্যই হয়তো আমরা আজকে বব মার্লেতে। আত্মার মুক্তি চাওয়া তিন পথের তিনজনকে কেমন এক করে দিল বব মার্লে!’
বেশ রাত হয়ে এসেছে তখন। উঠে পড়লাম তিনজনই। জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। দুটো কম্বলেও শীত মানল না। ছাড়া ছাড়া ঘুম। জানালার বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাতে দেখলাম আবহাওয়া ৪ ডিগ্রিতে নেমে এসেছে। ঘুম ভাঙল পাঁচটার পর। বাইরে চোখ পড়তেই তড়াক করে উঠে পড়লাম। সাদা বরফের চূড়ায় একটা পূর্ণ চাঁদ। আমার তখন দিশাহারা অবস্থা। আলো আসেনি তখনো। বরফচূড়ার ওপর শেষ চাঁদের আভা যে মায়া ছড়াল, সে মায়া থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। এরপর সূর্যের আভা এল। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে মাখামাখি করল।
আঁধার চিরে আলো এল—‘আমার মুক্তির আলোয় আলোয়...’!
বের হলাম একটু হোটেল থেকে। বাইরে তখন নতুন বরফের আস্তরণ। রাতে তুষারপাত হয়েছে। চোখ পড়ল ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ মোনালিসার ওপর! যেন মিটিমিটি হাসছে আর ডেকে বলছে, ‘কী! আমার কাছে তো এলে না!’
মনে মনে বললাম, ‘জানতাম না তোমরা প্রতিবেশী। পরেরবার আসব, কথা দিলাম।’

আরও পড়ুন