কিলিমানজারো অভিযান-৩
জড়িয়ে ধরে এ গাছের বয়স মাপা যায়
আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে উঁচু পর্বত কিলিমানজারোতে গিয়েছিলেন ইফতেখারুল ইসলাম। পর্বত আরোহণ ছাড়াও তানজানিয়ায় জাতীয় উদ্যানে সাফারি করেছেন তিনি। এ সফরের গল্প নিয়েই আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ পড়ুন তৃতীয় কিস্তি।
পানামা গার্ডেন হোটেলের প্রথম দিনটি আমার নিজস্ব। বিকেলে তেমন কোনো কাজ নেই। সেই রাতে খাওয়ার টেবিলে দেখা হয় আমাদের কয়েকজন অভিযাত্রীর সঙ্গে। সিঙ্গাপুর থেকে এসেছেন তাহসিন আর সেবাস্তিয়েন। খাবারের অর্ডার দেওয়া ও অপেক্ষা করার সময় বুঝতে পারি, তাঁদের সবকিছুতেই একটু সময় লাগে। আমাদের অর্ডার হয়ে যাওয়ার অনেক পর এসে যোগ দেন রওনক আপা ও আতিয়া আপা। তাঁরা দুজন পরদিন ভোরবেলা ডেনিসের সঙ্গে গাড়িতে করে চলে যাবেন আরেক শহর আরুশায়। তারপর তারেক অণুর সঙ্গে যাবেন লেক ন্যাট্রন দেখতে। আমি ওই দলে যোগ দিচ্ছি না। এত লম্বা সময় গাড়িতে বসে থাকতে পারি না। হিসাব করে দেখেছি, এতে সারাটা দিন চলে যাবে। তার চেয়ে বরং আমরা শহরটা ঘুরে দেখি। তাহসিন ও সেবাস্তিয়েন সেটাই করতে চান।
পরদিন সকালে হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা শহর দেখতে বের হই। আবহাওয়া চমত্কার। সকালে রীতিমতো শীত। জ্যাকেট পরে নরম রোদে আমরা হাঁটতে শুরু করি। শহরে পৌঁছে দু–একটা দর্শনীয় স্থান দেখানোর পর হাফিজ আমাদের নিয়ে যায় একটা শতাব্দীপ্রাচীন বাওবাবগাছের কাছে। এটা ট্যুরিস্টদের জন্য দ্রষ্টব্য স্থান।
তানজানিয়াজুড়ে সবখানেই বাওবাবগাছ দেখা যায়। বিশেষ করে কিলিমানজারো অঞ্চল এ গাছের জন্য বিখ্যাত। অরণ্য বা জাতীয় উদ্যানে তো বটেই, শহর ও শহরতলিতে পথের পাশে বহু জায়গায় রয়েছে বড় বড় দর্শনীয় গাছ। বাওবাবগাছের গুঁড়ি হয় বেশ মোটা। দুই হাত ছড়িয়ে গাছটাকে জড়িয়ে ধরে এর বয়স পরিমাপ করা যায়। বলা হয়ে থাকে, যতজন মিলে দুই হাত ছড়িয়ে গাছটাকে বেড় দেওয়া যাবে তাকে ১০ দিয়ে গুণ করে অনুমান করা যাবে গাছটির বয়স। দুজনে মিলে গাছটাকে বেড় দিতে পারলে গাছের বয়স ২০ বছর। মোশি শহরের এই বিখ্যাত গাছের শরীর জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করি তাহসিন, সেবাস্তিয়েন আর আমি। তিনজনে মিলে এর সামান্যই ধরতে পারি; ২৫ থেকে ৩০ জন মিলেও তা পারব কি না সন্দেহ।
বাওবাবগাছের নানা অংশের ব্যবহার ও উপকারিতার কথা শুনি। বাওবাবের মোটা কাণ্ড ও ডালপালার ভেতরে বিপুল পরিমাণে পানি জমা করা থাকে। হাজার হাজার লিটার পানি। কোনো কোনো বড় গাছে থাকতে পারে এক লাখ লিটার পর্যন্ত। এই পানি শুকনা মৌসুমে গাছটাকে বাঁচায়। প্রয়োজনে মানুষকেও বাঁচাতে পারে। দরকার হলে মানুষ গাছের কোনো একটা অংশ কেটে পানি বের করে নিয়ে তা করতে পারে। এর পুষ্টিকর ফল দেখতে ছোট আকারের বেলের মতো। সেই ফলের খোঁজে আর একটু হাঁটাহাঁটি করে আমরা গিয়ে পৌঁছাই একটা বাজারে। সেখান থেকে বাওবাব ফল কিনে নিয়ে ভেঙে ভেতরের সামান্য শাঁস খেয়ে দেখি আমরা। এত অল্পে কোনো উপকার আশা করা বৃথা।
আমাদের দলটাই সবচেয়ে বড়
সকালে হোটেল থেকে বের হওয়ার আগেই আমাদের ট্রেকিং সরঞ্জাম পরীক্ষা করা হয়েছে। হাফিজ ভালো করে দেখেছে, ওই উচ্চতায় আরোহণের জন্য আমাদের পোশাক, জুতা, মোজা—সবকিছু উপযুক্ত কি না। আমরা যাঁরা এখানে এসেছি, তাঁদের প্রত্যেকেই আগে পর্বতে কিছু অভিযান করে এসেছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেদের সব সরঞ্জাম আমরা নিয়েই এসেছি। তারপরও এখানকার পর্বতারোহণের জন্য আমাদের কিছু জিনিস লাগবে। তিনজনেরই কিছু জিনিস ভাড়া নিতে হবে। যেমন আমার লাগবে স্লিপিং ব্যাগ আর ওয়াটারপ্রুফ ডাফেল ব্যাগ।
পরের দিনেও ভাড়া নেওয়ার কাজটা সারা যেতে পারে। তবু আমি জোর দিয়ে বলি, আজই আমাদের তিনজনের কাজ সেরে ফেলা দরকার। কারণ, পরদিন অন্যরা এসে পৌঁছালে এই দোকানে আসবেন। তখন কাজ বেড়ে যাবে। নানাজনের নানা চাহিদা ও প্রশ্নে এরা কী রকম উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তা তো দেখেছি। কেন আমরা তখন অনাবশ্যক ভিড় বাড়াতে যাব। আমরা আমাদের পছন্দমতো জিনিস নিয়ে তারপর দুপুরের খাবার খেতে যাই। বিকেলে তিন চাকার টুকটুক বা সিএনজি নিয়ে ফিরে আসি আমাদের হোটেল পানামা গার্ডেনে।
সে রাতে আমাদের অন্য সহযাত্রীদের অনেকেই এসে পৌঁছান। কিন্তু হোটেলের রেস্তোরাঁয় রাত সাড়ে আটটার পর খাবারের অর্ডার নিতেই চায় না। রান্নাঘর রাত ১০টায় বন্ধ হয়ে যায় বললেও তার আগে থেকেই ওয়েটাররা নিখোঁজ হয়ে যান। কে, কীভাবে, কোথায় ডিনার করলেন, তা জানি না। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় সবার সঙ্গে দেখা হয়। এখন এ হোটেলে আমাদের দলটাই সবচেয়ে বড়। অনেকেই দ্রুত ব্রেকফাস্ট সেরে গাইডদের সঙ্গে বসে যাঁর যাঁর সরঞ্জাম মিলিয়ে নেন। কী কী জিনিস ভাড়া নিতে হবে, তার তালিকা করে নিয়ে সবাই রওনা হয়ে যান। সেবাস্তিয়েন, তাহসিন আর আমি হেঁটে হেঁটে আশপাশের এলাকাটা ঘুরে দেখি। একটা চমত্কার রিসোর্ট দেখে তার ভেতরে গিয়ে সেখানকার খোলা উদ্যানে বসি। উজ্জ্বল রোদ, গাছের ছায়া আর গরম কফির সঙ্গে উপভোগ করি নিজেদের গল্প ও আলসেমি।
কিলিমানজারো আরোহণের পাঁচটি নিয়ম
সঙ্গীরা সবাই তাঁদের কাজ সেরে ফিরে আসেন। সন্ধ্যায় পানামা গার্ডেন হোটেলে সময়মতো ডিনার সেরে সবাইকে গিয়ে জড়ো হতে হবে হোটেলের মিটিং রুমে। দুজন সঙ্গী তখনো ভিসা বা ফ্লাইট জটিলতার কারণে এখানে এসে পৌঁছাতে পারেননি। মিটিং রুমে গিয়ে দেখি, কয়েক সারি চেয়ার পাতা আছে। ঘরের মাঝখানে কয়েকটি চেয়ার আলো করে বসে আছেন কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ অভিযাত্রী। সবাই আমাদের ট্রেকসঙ্গী। আমিন ভাই আর মাহবুব ভাই ঢাকা থেকে গিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে এসেছেন তিনজন লেখক ও গবেষক—আনিসুজ জামান ভাই, শাহাব ইউনুস ভাই আর সাদ কামালী ভাই। এই পাঁচজনের মধ্যে বয়সে কে সবচেয়ে বড়, তা নিয়ে সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। অণু আমাকে অনুরোধ করে তাঁদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে। ওর ক্যামেরায় পাঁচ সিনিয়রকে একসঙ্গে ধরে রাখতে চায়। ওখানে যে কজন জ্যেষ্ঠতার দাবি জানাচ্ছিলেন, তাঁরা আমার বয়স জেনে দৃশ্যত নিরাশ হলেন। সদ্য ষাট পেরোনো যে কেউ আমার তুলনায় রীতিমতো তরুণ।
কয়েক মিনিটের মধ্যে অন্যরাও ওই ঘরে এসে হাজির হন। ২১ জন বসেছি। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ডেনিস কিলিমানজারো অভিযান বিষয়ে ব্রিফ করবে। ওর দলের অন্য সব গাইডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। ওরা সবাই দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে। ডেনিস ছাড়াও পাঁচ বা ছয়জন গাইড। তাদের মধ্যে একজন নারী। সপ্রতিভ, হাস্যোজ্জ্বল এই মেয়ের নাম হাওয়া। আছে এরিক, তওহিদ, হাফিজ ও আর একজন। সবাই বেশ মজা করে কথা বলে। আমাদের যাত্রাপথে কী কী করতে হবে, কী করা যাবে না, তার বিবরণ দেয়। ডে-প্যাক বা নিজের ব্যাকপ্যাকে কী রাখতে হবে আর কী কী দিতে হবে ডাফেল ব্যাগে। আলোচনার ইতি টানার সময় ডেনিস আবারও জোর দেয় কিলিমানজারো আরোহণের পাঁচটি নিয়মের ওপর।
রুল নাম্বার ওয়ান—পোলে পোলে...ধীরে ধীরে। রুল টু—ড্রিংক অ্যাজ মাচ অ্যাজ ইউ ক্যান। দিনে অন্তত তিন লিটার পানি। রুল থ্রি—ইট অ্যাজ মাচ অ্যাজ ইউ ক্যান। সুস্বাদু ও শক্তিদায়ক খাবার দেওয়া হবে, পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। পাহাড়ে উঠতে এনার্জি দরকার। রুল ফোর—স্লিপ অ্যাজ মাচ অ্যাজ ইউ ক্যান। প্রতি রাতে যতটা সম্ভব ঘুমাতে হবে। ঘুমের সময়ও গায়ে যেন কয়েক স্তর কাপড় থাকে। রুল ফাইভ—টেক ফোটোস অ্যাজ মাচ অ্যাজ ইউ ক্যান। যত পারেন ছবি তুলে নিন। কারণ, শতকরা আশি ভাগ অভিযাত্রী দ্বিতীয়বার কিলিমানজারো অভিযানে আসেন না। (চলবে)