কানাডায় ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে তিমির ছবি তুললাম
২০১৫ সাল। তখন আমরা প্রায় প্রতিদিন ফটোগ্রাফি নিয়ে আড্ডা দিতাম। বেশির ভাগ আড্ডাই হতো আলিম ভাইয়ের বাসায় অথবা আমার অফিসে। এর মধ্যে একদিন আফতাব ভাই নিউজিল্যান্ড থেকে এলেন। তিনি পেশায় চিকিৎসক হলেও নেশায় ফটোগ্রাফার। আমি তাঁর ছবির ভক্ত। সেদিন আমরা আলিম ভাইয়ের বাসায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। আফতাব ভাইয়ের বিভিন্ন ছবি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, কিন্তু তাঁর ফ্লিকারে তিমি মাছের লেজের ছবিটা আমার চোখে আটকে গেল। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, কোথায় তুলেছেন?
বললেন, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডায় তিমি মাছের ছবি তোলার ট্রিপ হয়।
মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, কখনো সুযোগ হলে ভ্যাঙ্কুভারে যাব, তিমির লেজের ছবি তুলব।
২০১৮ সালে এল সেই সুযোগ। কানাডার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ভ্যাঙ্কুভারে গেলাম। তিমির ছবি তুলব, ভীষণ উত্তেজিত। তীব্র ঠান্ডার মধ্যে সবাই বোটের ভেতরে বসে ছিল, ক্যামেরা হাতে আমি শুধু বাইরে ছিলাম, যেন একবার সুযোগ পেলেও মিস না করি।
বোট সমুদ্রের পাড় থেকে মাঝসমুদ্রের দিকে তিমির খোঁজে ঘুরছিল, কিন্তু তিমির দেখা মিলছিল না। ধীরে ধীরে মন খারাপ হতে শুরু করল। পুরো দিন কেটে গেল, তিমির দেখা নেই। শেষে তিমি না দেখেই আমাদের সেদিনের ট্রিপ শেষ হলো। গাইডরা বলল, বছরে ৩৬৫ দিনই তিমি দেখা যায়, কিন্তু আজই হলো না। তবে সমস্যা নেই, এই একই টিকিটে এক বছরের মধ্যে যেকোনো সময় এসে দেখা যাবে।
পরদিন আমাদের টরন্টোয় ফেরার কথা। ভাবলাম, আরেকটা দিন সময় নিই! পরদিন আবার গেলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেদিন আবহাওয়া ছিল খারাপ, সমুদ্রও উত্তাল—সেদিন গাইডরা বোটই নামাল না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ নিয়েই গুস মাউন্টেইন ঘুরে টরন্টো হয়ে দেশে ফিরে এলাম।
দেশে ফিরে শুনলাম, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের কাছাকাছি জায়গায় নাকি মাঝেমধ্যে তিমি দেখা যায়, তবে খুবই বিরল। সুতরাং সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে আরও কয়েক বছর কেটে গেল।
আবার লস অ্যাঞ্জেলেসে ঘুরতে গেলাম। চার দিনের ট্রিপ—প্রথম দ্রষ্টব্য ছিল গোল্ডেন গেট। রাতে পৌঁছালাম, ব্রিজ দেখলাম। তারপর গেলাম পিয়ার ৩৯–এ। জায়গাটা খুব সুন্দর, ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল ‘হোয়েল ওয়াচিং ট্রিপ’। সঙ্গে সঙ্গে মন জাগ্রত হলো; তিমির লেজ থেকে পানি ছিটানোর দৃশ্য দেখার সুপ্ত বাসনা আবার মাথা তুলল।
শুনলাম, আজকের সব ট্রিপ শেষ, তবে পরদিন সকাল ও দুপুরের স্লটে খালি আছে। পরদিন আমাদের লেক টাহোয় যাওয়ার কথা, কিন্তু তিমি দেখার লোভে পরিকল্পনা বদলে গেল। পরদিনের টিকিট বুক করলাম। রাতে হোটেলে ফিরে প্রচণ্ড উত্তেজনা—হয়তো এবার তিমি দেখতে পাব।
সকালে পিয়ার ৩৯ থেকে বড় একটি জাহাজে উঠলাম। অনেক মানুষ। গোল্ডেন গেট ব্রিজের নিচ দিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটল জাহাজ। কিছুক্ষণ পর সবার চিৎকার—তিমি দেখা গেছে! কিন্তু আমি যেহেতু নিজের চোখে তখনো দেখিনি, তাই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
গাইডরা নির্দেশনা দিচ্ছিলেন, কোন দিক তাকাতে হবে, কীভাবে লক্ষ রাখতে হবে। তাঁরা যতই কথা বলুন, আমার দুই চোখ শুধু পানির দিকে। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! তিমিকে দেখতে পেলাম! গাইডদের বর্ণনা অনুযায়ী প্রায় ৪৮ ফুটের হাম্পব্যাক তিমি।
ছবি তুলব, ভিডিও করব, নাকি শুধু চোখে দেখব, উত্তেজনায় কিছুই ঠিক করতে পারছিলাম না। আমার মতো বাকিরাও অসম্ভব উত্তেজিত। সবাই ছবি-ভিডিও নিতে ব্যস্ত, তাই দাঁড়ানোর জায়গাই পাচ্ছিলাম না যে একটু ভালোভাবে ছবি তুলব।
সমুদ্রের ঢেউয়ে বোট দুলছে, তার মধ্যে এত মানুষ—হঠাৎ একটা জায়গা খালি দেখে সেখানে দাঁড়ালাম। অনেকক্ষণ ধরে প্রস্তুত হয়ে আছি, তিমি পানি থেকে উঠলেই শাটার চাপব। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর হাতে ব্যথা হয়ে গেল। ঠিক যখন একটু সরে দাঁড়ালাম, একটা বিশাল তিমি পানির ওপরে লাফিয়ে উঠল!
ছবি তুলতে পারিনি, কিন্তু দেখে যে শান্তি পেয়েছি, ভাষায় তা প্রকাশ করা কঠিন। আবার অপেক্ষা। আরেকবার সুযোগ আসতেই কয়েকটা ক্লিক করলাম। তিমির মাথা, লেজ, পানিতে তার চলা, পাখার ঝাপটা—সবই ফ্রেমবন্দী করতে পারলাম।
এবার উপভোগ করব তিমির সাঁতার। তাই মুঠোফোন হাতে নিয়ে ভিডিও করতে লাগলাম। দেখলাম, একটি নয়, দুটি তিমি। সঙ্গে ছোট্ট বাচ্চাও আছে! মুহূর্তগুলো ছিল দারুণ সুন্দর। প্রায় আড়াই ঘণ্টার সেই ট্রিপে আমরা তিমি দেখলাম, ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম।
তারপর ফেরার পালা। আমার মনে তখন অদ্ভুত এক শান্তি। অবশেষে তিমির ছবি তুলেছি! বিখ্যাত গোল্ডেন গেট ব্রিজ পার হচ্ছি, কিন্তু আর ছবি তোলার আগ্রহ নেই। মনজুড়ে তখনো তিমির ভেসে ওঠা দৃশ্যগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।
সান ফ্রান্সিসকো ট্রিপ শেষ করে লেক টাহো ও বিগ সার ঘুরে লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরলাম। এর মধ্যেই বগুড়ার আরেক ভাই সেজান কল দিল। সে লস অ্যাঞ্জেলেসে আসছে, আমার সঙ্গে তিমি দেখবে। সে অ্যারিজোনা থেকে আট ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আসছে। আমার তোলা ছবি দেখে তারও তিমি দেখার তীব্র ইচ্ছা জেগেছে। কোথায় দেখবে, কবে দেখবে—সব টিকিটও করে রেখেছে।
২
পরদিন সকালে আমরা রওনা দিলাম নিউপোর্ট বিচের দিকে। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে মাত্র এক ঘণ্টার পথ। আমার মনেও ছিল, আবার একবার যাওয়া উচিত। প্রথমবার দেখে ফেলেছি, আলহামদুলিল্লাহ; এবার হয়তো আরও ভালো ছবি তুলতে পারব। ফটোগ্রাফিতে এমনই—একবার দেখে ফেললে পরেরবার সাবজেক্টের গতিবিধি সহজেই বোঝা যায়।
সকালে আমরা নিউপোর্টে পৌঁছালাম। আগেরবার ছিল বড় জাহাজ, এবার ২২ জনের ছোট নৌকা। নৌকার সুবিধা হলো, এগুলো গভীর সমুদ্রে যায় এবং তিমি দেখা গেলে যতটা সম্ভব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমার জন্য সেটি আরও ভালো সুযোগ। আবহাওয়াও দারুণ, পরিষ্কার নীল আকাশ। আমাদের সঙ্গে আনিকা আর আয়ানও ছিল। আয়ানকে খুব উত্তেজিত দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেল। সে তিমি দেখবে!
এবার আমি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী। তিমি দেখলে ভালো একটি ছবি তুলে ফেলতে পারব। এমনকি পানির ওপর থেকে লাফ দেওয়ার মুহূর্তও, যদি ভাগ্য সহায় হয়। নৌকা দ্রুতগতিতে গভীর সমুদ্রের দিকে এগোতে লাগল। সমুদ্র যদিও সব জায়গায় একই রকম দেখায়, তারপরও আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি। গাইডদের বর্ণনা অনুযায়ী সান ডিয়েগো থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে।
নৌকার আসন ছেড়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম, যেন যেদিক থেকেই তিমি উঠুক, সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলতে পারি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই একটি হাম্পব্যাক তিমির দেখা পেলাম। নৌকা দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেল। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি; তিমিটা হঠাৎ পানি ভেঙে লাফ দিয়ে ওপরে উঠল!
দেখতে দেখতে শাটার চাপলাম আর সেই স্বপ্নের শট পেয়ে গেলাম। এরপর ছবি তোলা একদম বন্ধ। এখন শুধু দেখা। যা হচ্ছে, তাকে দেখেই উপভোগ করা। তিমিটা আরাম করে সাঁতার কাটছে, পানি ছিটাচ্ছে, পানির নিচ থেকে উঠে শব্দ করছে। পানি থেকে লেজ নিচের দিকে নামাচ্ছে। তখনই মনে পড়ে গেল আফতাব ভাইয়ের সেই ছবির কথা।
ক্যামেরা লেজের দিকে তাক করে কয়েকটা ক্লিক করলাম। এত বড় একো প্রাণী, যে নৌকায় আমরা ছিলাম, তার চেয়ে বড়! আমাদের নৌকা ছিল প্রায় ৪৮ ফুট আর তিমিটা ছিল কমপক্ষে ৫০ ফুট।
ক্যামেরার ভিউফাইন্ডার দিয়ে যখন নিজের তোলা ছবি দেখতে লাগলাম, তখন মনে হলো, সমুদ্রের বিশালতার কাছে এত বড় একটা প্রাণীও কত ক্ষুদ্র!
যা–ই হোক, এরপর ফেরার পালা। ২০১৮ সালে কানাডায় দুই দিন চেষ্টা করেও যে জিনিস দেখতে পারিনি, আমেরিকায় এসে দুইবারেই তা দেখে ফেললাম।
ফিরতে ফিরতে আয়ান বলল, ‘বাবা, নেক্সট টার্গেট সবচেয়ে বড় ম্যামাল। ব্লু হোয়েল।’
আয়ানের কথা শুনে হাসলাম আর মনে মনে ভাবলাম—শীতে নয়, কোনো এক গ্রীষ্মে চেষ্টা করলে দেখা যেতেই পারে।