দুর্গম পাহাড়ে হরকাবানে তিন দিন আটকা ছিলেন, খাবারও ছিল না, এরপর কী করলেন একদল পর্যটক?
দুর্গম পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে হরকাবানের কবলে পড়েছিলেন একদল পর্যটক। তারপর জুমঘরে কাটাতে বাধ্য হলেন তিন দিন। সঙ্গে নেওয়া সামান্য খাবারও একসময় ফুরিয়ে এল। কী করলেন এরপর? রুদ্ধশ্বাস সেই অভিজ্ঞতাই লিখেছেন দলটির মিঠুন আচার্য
তৈনখালের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পালংখিয়াং পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। জলপ্রপাতটা বান্দারবানের আলীকদমে পড়েছে। এটির তিনটি অংশ। নিচের খালপাড় ধরে আমরা একেবারে ওপরের অংশে উঠেছি। এই অংশে পর্যটকদের থাকার জন্য কয়েকটি জুমঘর আছে। রাতে থাকার জন্য দুটি আমরা নিয়েছি। জলপ্রপাত দেখতে অন্য কোনো দল আসেনি বলে পালংখিয়াং এখন শুধুই আমাদের রাজত্ব।
জুমঘরে ব্যাগ রেখেই সবাই জলপ্রপাতের কাছে চলে যাই। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি ভুলতে কেউ কেউ শীতল জলে পা ডুবিয়ে পাথরে বসে পড়েন। উৎসাহী দু-একজন পানিতে ঝাঁপাঝাঁপিও শুরু করেন। কেউ কেউ নিজেদের ছবি তুলতে থাকেন। কয়েকটি ছবি তুলে আমিও নেমে পড়ি।
একজন গাইডসহ দলে আমরা ১১ জন। নারী সদস্যও আছেন কয়েকজন। আলীকদম থেকে প্রথমে নৌকায়, পরে কয়েক ঘণ্টা হেঁটে ২৫ জুলাই বিকেলে হাজিরাম পাড়ায় আসি। হাজিরাম পাড়া থেকে আজ পালংখিয়াংয়ের পথ ধরি। হাজিরাম পাড়া থেকে এখানে আসার দুটি পথ—পাহাড়ের ওপর দিয়ে, তৈনখালের পাড় ধরে। খালের পাড় ধরে এলে সময় কম লাগে। আমরাও তৈনখালের পাড় ধরেই এসেছি। বর্ষার সময় এ পথে ঝুঁকি বেড়ে যায়, কারণ, কয়েকবার খাল পার হতে হয়। পালংখিয়াংয়ের প্রতিবেশী যে খাল, সেটি বেশ খরস্রোতা। পাহাড়ের ওপর দিয়ে এলেও এই খাল পার হতে হয়। গাইডসহ আমরা যাঁরা সাঁতার জানি, তাঁরা অন্যদের সাহায্য করে সেই খাল পার করেছি।
অপরূপ জলপ্রপাত, ভয়ংকর জলপ্রপাত
দিনভরই থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তাই তেমন গরম নেই। জলপ্রপাতের ওপরের অংশে কিছুক্ষণ ভিজে সবাই নিচের অংশের দিকে নামতে থাকি। নিচে জল পতনের শব্দ, স্বচ্ছ জলের ধারা। এক পাথর থেকে আরেক পাথর ধরে আমরা জলপ্রপাতের কাছে যাই। বৃষ্টি বাড়তে থাকলে দ্রুত উঠে আসার জন্য আমাদের তাগাদা দেন গাইড। সবাই জলপ্রপাতের সঙ্গে দ্রুত ছবি তুলি।
আধঘণ্টার মতো কেটে যায়। ততক্ষণে জলপ্রপাতের স্বচ্ছ ধারা ঘোলা হয়ে গেছে। জল পতনের গতিও বেড়েছে। দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাতেও পানি বেড়ে গেছে কয়েক সেন্টিমিটার। ওপরে ওঠার জন্য পাড়ে আসতে গিয়ে দেখা গেল কারও কারও প্রায় কোমরসমান পানি, সঙ্গে তীব্র স্রোত, প্রতি সেকেন্ডেই যা ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। দড়ি বেঁধে এক এক করে অন্য সদস্যদের নিরাপদে জলপ্রপাতের কাছ থেকে পাড়ে নিয়ে আসি। এর মধ্যেই শুরু হয় ঝুমবৃষ্টি। দেখতে দেখতে অপরূপ জলপ্রপাত ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। আমরা দ্রুত পাহাড়ের ওপরে উঠতে থাকি। উঠতে উঠতে তখন প্রায় সন্ধ্যা।
রাতে এখানেই থাকব। দুই বেলা খাবারের প্রস্তুতিও আছে—রাতের জন্য ভারী আর সকালের জন্য হালকা খাবার। তবে গাইড আশঙ্কা প্রকাশ করলেন—এভাবে বৃষ্টি হতে থাকলে সকালেও ফেরা সম্ভব হবে না।
আমাদের পরিকল্পনা হলো ২৭ জুলাই সকালে পালংখিয়াং থেকে রওনা হয়ে সন্ধ্যার মধ্যে আলীকদম পৌঁছে রাতে ঢাকার বাস ধরা। ২৮ জুলাই সবার অফিস। গাইড মানসিক প্রস্তুতির জন্য সবাইকে বললেন, ‘বৃষ্টি না কমলে আমরা ঝুঁকি নিয়ে যাব না।’
মুরগির মাংস ও ডাল রেঁধে আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। সবার মধ্যে অজানা আশঙ্কা। এখানে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই। সময়মতো ফিরতে না পারলে পরিবারের সদস্যরা চিন্তায় পড়ে যাবেন, আবার অফিস ধরার তাগাদাও আছে। এসব চিন্তা নিয়েই রাত কেটে যায়।
সকালে বৃষ্টি কিছুটা কমে আসে। আমরা সবাই খুশি হয়ে উঠি—যাক পূর্বনির্ধরিত রুটিনমাফিকই যাওয়া যাবে। রওনা হব ভাবছি, এমন সময় আবার বৃষ্টি। জুমঘরে বসে তৈনখালের ভয়ংকর রূপ দেখতে থাকি। একই সঙ্গে জলপ্রপাতও যেন ভয়ংকর হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। টিমের একজনের কাছে বুস্টার ফোন ছিল। এই ফোনে মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। অনেক চেষ্টার পরে দু-একজন তাঁদের অবস্থান পরিবারকে জানাতে পারেন। কিন্তু আমরা দলে অধিকাংশই অপরিচিত। একজনের মাধ্যমে অন্য জনের পরিবারের কাছে বার্তা পৌঁছানোর উপায় নেই।
চাল ফুরিয়ে গেল
সঙ্গে যা খাবার আছে, সকালে খেলেই শেষ। এরপর কী হবে? তাই আমরা সকালে খিচুড়ি না রেঁধে শুধু চা-বিস্কুট দিয়ে নাশতা সারি। দুপুরেও তা-ই। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল চলে আসে। তারা আলীকদম সার্কিট ট্রেকে বের হয়েছিলেন। উল্টো দিক থেকে এখানে এসেছেন। তাঁদের কাছে শুধু শুকনা খাবার আছে। আমাদের সঙ্গে যা চাল ছিল, দুই দলের জন্য খিচুড়ি রেঁধে তা রাতের বেলাতেই শেষ হয়ে গেল।
২৮ জুলাই সকালে চা-বিস্কুট খেয়ে আর খিদে মানছিল না। আবার কতক্ষণ এখানে আটকে থাকতে হবে কে জানে! দুই দলের গাইড তাই ঝুঁকি নিলেন। তাঁরা চাল আনতে চলে গেলেন। ঘণ্টা পাঁচেক পর পাঁচ কেজির মতো চাল নিয়ে ফিরলেন। চালটুকু দুই গ্রুপের মধ্যে ভাগ করা হলো। পরের বেলার কথা ভেবে আমাদের ভাগ থেকে এক কেজি চাল রেখে দিলাম। অন্য দল আমাদের একটি কাঁচা পেঁপে দিল। দুপুরে রান্নার দায়িত্ব আমিই নিলাম। পেঁপে কেটে ঝোল করে রান্না করলাম। দেড় কেজি চালের ভাতে কি আর ১১ জনের খিদে মেটে!
এর মধ্যেই বৃষ্টি কমল। ঘণ্টা দুয়েক পর খালে পানিও কমতে থাকল। সন্ধ্যার আগে আগে অনেকখানিই কমে এল পানির চাপ। এই সুযোগ আমরা মিস করতে চাইলাম না। ঝটপট একে একে নিচে নেমে এলাম। দড়ি ধরে ধরে একে অন্যকে সহায়তা করে মূল জলপ্রপাতের একপাশ থেকে অন্য পাশে চলে এলাম। এবার তৈনখালের পাড় ছেড়ে পাহাড়ি পথে হাঁটা শুরু করলাম। রাতের অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে দুই ঘণ্টা পর আমরা একটি পাড়ায় চলে আসি। সম্ভবত বমপাড়া। পর্যটকদের এখানে নিয়মিত যাতায়াত। রাতে এই পাড়াতেই থাকার ব্যবস্থা হলো। গাইড সবার উদ্দেশে বললেন, ‘আর কোনো চিন্তা নেই, কাল বিকেলের মধ্যেই আমরা আলীকদম পৌঁছাত পারব।’
সারা জীবন এক ভয়ংকর সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়ে থাকবে এই ভ্রমণ!