৬৪ জেলায় ভ্রমণে আমাদের প্রধান বাধা কী ছিল, জানেন?

সাখাওয়াত হোসেন ও জান্নাতুল ইসলাম দম্পতি সবার কাছে সাফাত–শিখা নামেই পরিচিত। বিয়ের পর এখানে–সেখানে বেড়াতে বেড়াতে দুজনে একসময় ঠিক করলেন, হাতে হাত রেখে দেশের সব কটা জেলাই ঘুরে দেখবেন তাঁরা। ১৮ আগস্ট ভ্রমণতালিকার ৬৪তম জেলা কুড়িগ্রাম ঘুরে দেখার মাধ্যমে শেষ হলো তাঁদের সেই সফর। কেমন ছিল অভিজ্ঞতা? শুনিয়েছেন সাখাওয়াত হোসেন

বান্দরবানের একটি জলপ্রপাতে সাফাত–শিখা দম্পতি

বিয়ের আয়োজনের ছবি তুলতে দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে অভিজ্ঞতা কম হয়নি। নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির বিয়ের আয়োজন কাছ থেকে দেখেছি, ছবি তুলেছি। বাসায় ফিরে সেসব অভিজ্ঞতা গল্পচ্ছলে শিখাকে শোনাতাম। শুনে মাঝেমধ্যে অনুযোগ করত ও। তারও যে ভ্রমণের বাতিক! দেশটা ঘুরে দেখার ইচ্ছা। একসময় দুজনেই বেরিয়ে পড়তে শুরু করলাম। একটা সময় লক্ষ করলাম, আমাদের দেশটা ছোট হলে কী হবে, বৈচিত্র্যের শেষ নেই। পাহাড়, সমুদ্র আর চা-বাগানের বাইরের সেই বৈচিত্র্য কি আমরা দেখব না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই আমাদের অদেখা-অজানা জায়গাগুলোতে যাওয়া শুরু। এভাবে কয়েকটা জেলা ঘোরার পর ৬৪ জেলাই ঘুরে দেখার ইচ্ছা জাগল। সেই সঙ্গে আমার আলোকচিত্রী মনের চাওয়াটাও যুক্ত হলো—প্রতিটা জেলায় নিজেদের অভিজ্ঞতার অন্তত একটা সুন্দর ছবি স্মৃতি হিসেবে রাখতে হবে!

আরও পড়ুন
সিলেটের মালিনীছড়া চা-বাগানে

সিলেটে শুরু, কুড়িগ্রামে শেষ

শিখা আর আমি সহপাঠী, বন্ধু। চট্টগ্রামে একই কলেজে পড়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অনুষদে ছিলাম। পড়াশোনা শেষ করে ২০১৭ সালে গাঁটছড়া বাঁধি। ঢাকা শহরের ঝুটঝামেলা থেকে প্রাণভরে শ্বাস নিতে সেবার আমরা সিলেট, শ্রীমঙ্গল আর হবিগঞ্জ ঘুরেছি। বিয়ের পর সেই প্রথম একসঙ্গে বাইরে যাওয়া। সিলেটে ঘোরার সময় একদিন খুব ভোরে উঠে মালিনীছড়া চা-বাগান দেখতে গেছি। আশপাশে কাউকে না পেয়ে ‘ফলো মি’ গোছের ছবি তুলি আমরা। এটা আমাদের ভ্রমণ অ্যালবামের সবচেয়ে পুরোনো ছবি।

কুড়িগ্রামের উলিপুর মুন্সিবাড়িতে

এরপর ৬৪ জেলা ভ্রমণের অভিযাত্রা শুরু হলো। এই যাত্রায় আমাদের শেষ জেলা কুড়িগ্রাম। লালমনিরহাট ঘুরে গত ১৮ আগস্ট কুড়িগ্রামে যাই। ধরলা ব্রিজের ওপর সন্ধ্যাটা কাটাই। পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি উলিপুর মুন্সীবাড়ির উদ্দেশে। শুনেছি, আঠারো শতকে চমৎকার স্থাপত্যের এই জমিদারবাড়িটি নির্মাণ করান বিনোদীলালের পালক ছেলে ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সি। কুড়িগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে গন্তব্য। অটোরিকশায় কুড়িগ্রামের নানা জায়গা দেখতে দেখতে সেখানে পৌঁছাই। ৬৪তম জেলা ভ্রমণের শেষ ছবি তুলব বলে নিজেদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা কাজ করছিল। কিন্তু ছবি কে তুলবে, কীভাবে তুলবে, ভেবে পাচ্ছিলাম না। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর এক অটোরিকশাচালকের সঙ্গে দেখা। ক্যামেরায় অনভ্যস্ত মানুষটাকে মিনিট দশেকের কোর্স করাতে হলো! বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর কাঙ্ক্ষিত ছবিটি তোলা গেল। শেষ ছবিটা তুলেই চলে যাই উলিপুরের বিখ্যাত পাবনা হোটেলে। ক্ষীরমোহন দিয়ে নিজেরাই উদ্‌যাপন করলাম নিজেদের ৬৪ জেলা ভ্রমণের মাইলফলক!

আরও পড়ুন
shakhawat hossen shafat

বিয়ে বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড, বাসস্ট্যান্ড থেকে অফিস

৬৪ জেলা ভ্রমণের এই যাত্রা সহজ ছিল না। দুজনের কাজের ধরন আলাদা। আমি আলোকচিত্রী আর শিখা একটি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। শিখার শুক্র ও শনিবার ছুটি, আমার হয়তো এই দুটি দিনেই বেশি ব্যস্ততা। তবু এই দুই দিনেই আমরা বেশি ভ্রমণ করেছি। এ জন্য আমার দলের সদস্যরা সহায়তা করেছে। তারাই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমাকে ছুটি দিয়েছে। তবু দেখা যেত বৃহস্পতিবার কাজ শেষ করে আর বাসায় যাওয়ার সুযোগ পেতাম না, ক্যামেরা-ব্যাগ নিয়ে সোজা চলে যেতে হতো বাসস্ট্যান্ড। শিখার ক্ষেত্রে আবার আরেক রকম হতো। রোববার তার অফিস করার কথা। কিন্তু অনেক সময় বাস ঢাকায় পৌঁছাতে দেরি করে ফেলত, তখন তড়িঘড়ি ব্যাকপ্যাক নিয়েই ছুটতে হতো অফিসে।

এর মধ্যে আবার কোভিডকালে দীর্ঘ বিরতি পড়ল! মনে হচ্ছিল স্বপ্নটা বুঝি অধরাই থেকে যাবে। তবে হাল ছাড়িনি। সময়-সুযোগ যখনই পেরেছি, ছুট দিয়েছি।

পাবনার হার্ডিঞ্জ ব্রিজে

পথে পথে অভিজ্ঞতা

এই ছুটে চলতে গিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। নানা রকম মানুষের সঙ্গে মিশতে পেরেছি, বিভিন্ন জীবনদর্শন, ইতিহাস, খাবার নিয়ে জানতে পেরেছি। এই স্মৃতিগুলো আমাদের আজীবনের সম্পদ।

অটোচালক ডাবলু মিয়ার কথা আলাদা করে বলতে হয়। ঝিনাইদহে তাঁর অটো ভাড়া করেছিলাম। চলতে চলতে তিনি ঝিনাইদহে আসার বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন। কোনো কাজে না, শুধুই ভ্রমণে এসেছি শুনে ভদ্রলোক খুব আগ্রহী হয়ে উঠলেন, আমাদের সঙ্গে সারা দিন থাকলেন। আমাদের পরিকল্পনায় যেসব জায়গা ছিল সেসব তো দেখালেনই, নতুন আরও তিন-চারটা জায়গা দেখালেন ডাবলু মিয়া।

বাজে অভিজ্ঞতাও আছে! দিনাজপুর গেছি। সঙ্গে আমার শ্যালকও আছে। থাকার জন্য একটা হোটেলে গেছি। কিন্তু কিছুতেই তাঁরা আমাদের রুম ভাড়া দেবে না। কারণ, আমার সঙ্গে একজন নারী আছে। আমাকে সন্দেহে করছে! বাধ্য হয়ে পাসপোর্টের কপি দিলাম, যেখানে আমাদের বৈবাহিক তথ্য আছে। তারপরও তাঁরা থাকতে দিল না। শেষমেশ পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে হোটেল ম্যানেজ করতে হলো।

আরও পড়ুন
রাতের ঢাকায় দুজনে

জামালপুরের অভিজ্ঞতা আরও তিক্ত। হোটেলে রুম না পেয়ে রাতে দুজনে পাশের জেলা শেরপুরে গিয়ে এক বাসায় ছিলাম। সেই বাসাটাও আবার জোগাড় করতে হয়েছিল এক বন্ধুর লতায়-পাতায় আত্মীয়তা খুঁজে! সত্যি আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রাতে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করা। স্বামী-স্ত্রী হওয়ার পরও রুম না পাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের ব্যথিত করেছে।

সবার ভালোবাসা

কুড়িগ্রাম ভ্রমণ শেষ করে এসে আমি আমার ফেসবুক প্রোফাইলে একটি অ্যালবাম শেয়ার করি। ‘৬৪ জেলা ৬৪ ছবি’ নামের অ্যালবামটি ভাইরাল হয়ে যায়। হাজার হাজার শেয়ার হয়েছে। অনেক দম্পতি হয়তো আমাদের মধ্যে তাদের সুপ্ত ভ্রমণ–ইচ্ছাকে খুঁজে পেয়েছে। সবার এত এত প্রশংসা, উচ্ছ্বাসের ভিড়ে আমাদের ভালো লাগা এইটুকুই যে আমরা আমাদের দেশ ভ্রমণের স্বপ্নটা পূরণ করতে পেরেছি। আমাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যদি একজনেরও ভ্রমণদর্শন বদলায়, দেশটাকে দেখার ইচ্ছা জাগে, তারচেয়ে বড় পাওয়ার আর কিছু নেই!

আরও পড়ুন