পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর থেকে দুই ছেলেকে চিঠি পাঠালাম

সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন ত্রয়োদশ পর্ব

অ্যান্টার্কটিকার পেঙ্গুইন ডাকঘর
ছবি: সংগৃহীত

অপারেশনের জন্য তৈরি হয়ে রিসিপশনে গিয়ে দেখি বেশ জটলা। সবাই হুড়মুড় করে পোস্টকার্ড কিনছে। মোট ছয় রকমের পোস্টকার্ড রাখা। প্রতিটির মূল্য তিন ডলার। একটু আগে যে ব্রিটিশ কর্মকর্তার প্রেজেন্টেশন দেখলাম, তাঁর কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছেন, ‘আমরা তাদের যে ঘাঁটিতে যাব, সেখানে একটা পোস্ট অফিস আছে। তার নাম “পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস”। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ডাকঘর।’

পোস্টকার্ড কিনতে অভিযাত্রীরা রীতিমতো ঠেলাঠেলি শুরু করেছেন। কেউ কেউ কিনছেন, কেউ কেউ কার্ডে লিখতে শুরু করেছেন। আর কয়েকজন মুঠোফোনে চিঠি পাঠানোর ঠিকানা হাতড়াচ্ছেন। পেছন থেকে জিমি সাহেব ডেকে বললেন, ‘মহুয়া, আপনাদের গ্রুপকে ডাকছে, দ্রুত জোডিয়াকে উঠুন।’

জোডিয়াকে উঠে ব্রিটিশ ঘাঁটিতে পৌঁছাতে খুব কম সময় লাগল। জোডিয়াক থেকে নামার আগে চোখে পড়ল সামনে ছোট্ট একটি নোটিশ বোর্ড। সেখানে লেখা, ‘ওয়েলকাম টু অ্যান্টার্কটিক ট্রিটি হিস্ট্রিক সাইট নম্বর ৬১ ব্রিটিশ বেজ-এ, পোর্ট লকরয়’।

অ্যান্টার্কটিকায় এ রকম ৯৫টি ‘ঐতিহাসিক স্থান’ আছে। যা মূলত সংরক্ষিত অঞ্চল। এই ব্রিটিশ ঘাঁটির অফিশিয়াল নাম ‘পোর্ট লকরয়’। জোডিয়াক থেকে নামতে গিয়ে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। নামার জায়গাটি জোডিয়াক থেকে বেশ উঁচুতে। গাইডের সহযোগিতা ছিল বলে রক্ষা। নেমেও বিপদ, পথে যত্রতত্র পেঙ্গুইনের মল। পেঙ্গুইনেরা জায়গাটাকে একেবারে যাচ্ছেতাই বানিয়ে রেখেছে। পিছলে পড়তে পড়তে শক্ত হয়ে দাঁড়াই। আবার হাঁটি। চারদিকে শত শত পেঙ্গুইন।

আরও পড়ুন
সবাই ডাকটিকিট কিনছে
ছবি: লেখক

এখানে চার-পাঁচটি ঘর। তবে ভেতরে ঢোকার ফটক একটা। ঘরের বাইরে সাদা বরফ। প্রবেশপথে স্যানিটাইজের ব্যবস্থা। লম্বা সারি বেঁধে দাঁড়াতে হলো। একজন একজন করে জুতা স্যানিটাইজ করতে হবে। স্যানিটাইজে সময় লাগছে বেশি। পেঙ্গুইনের মল জুতায় লেগেছে, ব্রাশ দিয়ে ঘষে ঘষে সাফ করতে হচ্ছে। পরের পর্যায়ে মোটা ছালার মতো কাপড় বিছানো আছে, তাতে জুতা ঘষে শুকালাম। এসব খাটাখাটনি শেষ করে প্রবেশ করলাম ভেতরে।

সাদামাটা কক্ষ। প্রবেশমুখের দেয়ালে লাগানো একটি লাল পোস্টবক্স। দৃশ্যমানতা বাড়ানোর জন্য ১৮৮৪ সাল থেকে ‘লাল পোস্টবক্স’ ব্যবহার করছে ব্রিটিশরা। ডাকবাক্সের গায়ে দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্ট্যাম্প এবং স্কটিশ মুকুট আঁকা।

পোস্টকার্ড আগেই কিনেছি, কিন্তু কিছুই লেখা হয়নি। চিঠি লেখার সময়ই পাচ্ছি না। চারদিকে দেখব, নাকি লিখব? এক অভিযাত্রী টেবিল দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে লিখতে পারো।’ আমি চিন্তামুক্ত হলাম। দুই ছেলেকে কী লিখব—এই ভেবে হাত কাঁপছে। কোনো দিন সন্তানদের চিঠি লিখিনি। ওরাও চিঠি বিদায়ের যুগে জন্ম নিয়েছে।

ডাকবাক্স পেরিয়ে ডানে প্রবেশ করলে একটি বৃহৎ কক্ষ। সে কক্ষের বড় জায়গাজুড়ে রকমারি স্যুভেনির বিক্রয়ের জন্য, সবই অ্যান্টার্কটিকা–সম্পর্কিত। অন্য পাশে দুজন কর্মকর্তা ব্যস্ত স্ট্যাম্প বিক্রি, খাম আর পোস্টকার্ডে স্ট্যাম্প লাগিয়ে নিয়ে। এখানেও দীর্ঘ লাইন পড়ে গেল। এখান থেকে স্ট্যাম্প কিনে নিতে হয়, আমি দুটি স্ট্যাম্প নিয়ে তার মূল্য পরিশোধের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। সারি ধরে সামনে এসে পোস্টমাস্টারকে জিজ্ঞেস করলাম, এই পোস্টকার্ড পৌঁছাতে কত দিন লাগবে?

এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর
ছবি: লেখক

পোস্টমাস্টার লম্বা কাহিনি শোনালেন, প্রথমে এই মৌসুমের শেষে চিঠিগুলো জাহাজে করে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে নেওয়া হবে। ফকল্যান্ড থেকে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর সাহায্যে পরের গন্তব্যে পৌঁছানো হবে। সেখান থেকে ধাপে ধাপে চিঠিগুলো ঠিকানায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে। একবার চিঠি পৌঁছাতে সাড়ে আট মাস লেগেছিল।

মনে মনে বলি, চিঠি একদিন পৌঁছালেই হলো, আমার কোনো তাড়া নেই।

প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল। তখন এই পোস্ট অফিস এবং সংলগ্ন জাদুঘরটি পরিচালনার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্রিটেনের গণমাধ্যমে ফলাও করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কোভিড–পরবর্তী প্রথম মৌসুমে প্রায় চার হাজার আবেদন জমা পড়ে। বেছে নেওয়া হয় চারজন। নির্বাচিতরা নারী।

এখানকার দায়িত্বে আছেন সারা নামের একজন। তিনি পোস্ট অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে। বললেন, চার মাস ধরে আছেন। সারা দেখতে বেশ তরুণ, দীর্ঘ শরীর, সদা হাস্যমুখ। হাতে ওয়াকিটকির মতো একটা কিছু। অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে রসিকতার সুরে বললেন, এই পেঙ্গুইন পোস্ট অফিসের দায়িত্ব নেওয়ার পর সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছিল একটা বেলচা। কারণ আর কিছুই নয়, পেঙ্গুইনের মল। পেঙ্গুইন-বর্জ্য এত বেশি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল যে সেসব পরিষ্কার করতেই লেগে গেছে কয়েক দিন।

এই ছোট্ট দ্বীপে হাজারের বেশি জেনটু পেঙ্গুইনের বাস। পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের পোস্ট অফিস পরিচালনার কাজটিকে সারা গৌরবের মনে করেন। তাঁর চোখেমুখে আত্মতৃপ্তির অভিব্যক্তি। মাথার ওপরের সূর্যের প্রখরতায় তা আরও স্পষ্ট। বললেন, এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। ১৯৪৪ সালে ব্রিটেনের প্রথম স্থায়ী অ্যান্টার্কটিক ঘাঁটি এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে পর্যটকদের প্রিয় স্থান হয়ে ওঠে। এটি বরফে ঢাকা মহাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত স্থানগুলোর একটি। এই পোস্ট অফিস থেকে বছরে প্রায় ৮০ হাজার কার্ড বিশ্বের প্রায় ১০০ দেশে পাঠানো হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি ব্রিটিশদের একটি গোপন যুদ্ধকালীন ঘাঁটি ছিল। এরপর ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক জরিপের জন্য এটিকে গবেষণাকেন্দ্র করা হয়। পরে এটি পোস্টকার্ড এবং চিঠি পাঠানোর অনুমতি পায়। এখান থেকে পাঠানো চিঠিতে একটি বিশেষ অ্যান্টার্কটিক স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টার্কটিকা থেকে চিঠি পাঠানোর এই সুযোগের কারণেই এটি দর্শনার্থীদের পছন্দের।

সারা বললেন, ‘এটি আনন্দের চাকরি কিন্তু আরামের নয়। প্রতিদিন আমাদের প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়। পাঁচ মাস ধরে আমাদের এক কক্ষে অবস্থান করতে হয়। সরবরাহ পানি নেই। ফ্লাশিং টয়লেট নেই। কোথাও পালানোর জায়গাও নেই। সপ্তাহে দুদিন ছুটি আছে। খাবার মূলত টিনজাত বা শুকনা। পর্যটকদের জাহাজে করে সেগুলো আসে।’

‘যদি গোসল করতে ইচ্ছা হয়, তবে কি এই সাগরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন?’ আমার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন সারা। ‘গোসল বা ফ্লাশিং টয়লেট ব্যবহারের ইচ্ছে হলে আমরা পর্যটকবাহী জাহাজে যাই। সে সুযোগটি নিই। সাগরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ায় নিষেধাজ্ঞা আছে কি না জানি না, তবে তা আমরা করি না।’

সারার সঙ্গে আলাপ বেশ জমে উঠেছে। তাঁকে ছাড়তে মন চাইছে না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে আপনাদের প্রধান কাজ কী?’

‘যেদিন পর্যটকবাহী জাহাজ ভেড়ে, সেদিন স্ট্যাম্প, পোস্টকার্ড আর স্যুভেনির বিক্রি করেই কেটে যায়। তা ছাড়া এখানে পেঙ্গুইন জরিপ করি আমরা। জেনটু পেঙ্গুইনের প্রজননপদ্ধতির ওপর বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করি। কাজটি কয়েক দশক ধরে চলছে।’

আমার কেবিন বন্ধু নাসতা আটটি পোস্টকার্ড কিনেছে। আমি তো হতবাক, ‘এত কিনেছ কেন?’

নাসতা বলল, ‘এই মাসে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুর জন্মদিন। তাদের শুভেচ্ছা জানাব।’

আরও পড়ুন

১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?

২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা

৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’

৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি

৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি

৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী

৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি

৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়

৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম

১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই

১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল

১২. অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্‌যাপিত হলো জন্মদিন