স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। যেকোনো রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে আমাদেরকে যোগাযোগ করতে হয়। এ কারণে স্লোভেনিয়াতে পা রাখার পর বেশ কয়েকবার আমার ভিয়েনাতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে এবং এভাবে ভিয়েনাতে যাতায়াতের সুবাদে সেখানে বসবাসরত অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে উঠেছে। এমন একজন হচ্ছে মাহবুবুর রহমান।
মাহবুবুর রহমান অস্ট্রিয়ায় পাড়ি জমানো প্রথম দিককার বাংলাদেশিদের মধ্যে একজন। তাঁর আরও একটি পরিচয় আছে, তিনি হচ্ছেন আমাদের দেশের সূর্যসন্তানদের একজন অর্থাৎ তিনি আমাদের দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশ নেওয়া এক মুক্তিযোদ্ধা। পরের দিন তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে সকালের জলখাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মাহবুব ভাই সত্যিকার অর্থে অমায়িক একজন ব্যক্তিত্ব। আমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন। তাই তাঁর আমন্ত্রণ পাওয়ার পর আমি সেটা গ্রহণ না করে পারলাম না। আমাকে তিনি তাঁর গাড়িতে করে পরের দিন সকালে ওয়েস্টব্যানহফে নিয়ে গেলেন। ওয়েস্টব্যানহফ হচ্ছে ভিয়েনার পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলোর প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। সকালের জলখাবার আমরা একসঙ্গে সেরে নিলাম। এরপর তিনি আমাকে ওয়েস্টব্যানহফ থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলেন।
বেলা সাড়ে বারোটায় আমার ফ্লাইট। দুই ঘণ্টা হাতে রেখেই এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। গ্রিসে ভ্রমণের জন্য সবাইকে সে দেশের সরকারের ভ্রমণবিষয়ক একটি ওয়েবসাইটে (travel.gov.gr) গিয়ে পিএলফএফ ফরম পূরণ করতে হয়। সেখানে সবাইকে প্রয়োজনীয় তথ্যদি হালনাগাদ করতে হয়। সঠিকভাবে পিএলএফ ফরমটি পূরণ করা হয়ে গেলে তারা আপনাকে ই-মেইল পাঠাবে।
এরপর যেদিন ফ্লাইট, সেদিন দিবাগত রাত বারোটায় গ্রিসের ইমিগ্রেশনের পক্ষ থেকে একই কিউআর কোড পাঠানো হবে আপনার ই-মেইলে। এ কিউআর কোড ছাড়া কাউকে গ্রিসে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। এ ছাড়া গ্রিসের সরকারি তালিকায় করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে রেড জোন হিসেবে যেসব দেশকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, সেসব দেশ থেকে কেউ গ্রিসে আসতে চাইলে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে কোভিড-১৯–এর নেগেটিভ সনদ বহন করতে হবে।
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অবশেষে ফ্লাইটে উঠলাম। ভিয়েনার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থেকে শুরু করে এয়ারপোর্টের ভেতর সর্বত্র মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক। এমনকি ফ্লাইটেও সর্বক্ষণ আমাদের মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে ভিয়েনা কিংবা লুবলিয়ানাতে মানুষের তেমন পদচারণ চোখে না পড়লেও এয়ারপোর্টের ভেতরের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অস্ট্রিয়া যেহেতু স্থলবেষ্টিত একটি দেশ, তাই সে দেশের অনেক অধিবাসী গ্রীষ্মকালসহ বছরের এ সময়টাকে উপভোগ করার জন্য আশপাশের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ইতালি, ক্রোয়েশিয়া ও গ্রিসের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলোর প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল। তাই করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে ভেবেছিলাম হয়তোবা ফ্লাইটে খুব বেশি মানুষের দেখা মিলবে না, ফ্লাইটে ওঠার পর দেখা গেল পুরো অ্যারোপ্লেন কানায় কানায় পূর্ণ। ফ্লাইটের সিংহভাগ যাত্রী অস্ট্রিয়ার। অল্প কিছুসংখ্যক যাত্রী ছিল গ্রিস, স্লোভেনিয়া, বুলগেরিয়াসহ অন্যান্য দেশের নাগরিক।
প্রায় দেড় ঘণ্টার যাত্রা শেষে থেসালুনিকির নর্থ ম্যাকাডোনিয়া এয়ারপোর্টে আমাদের ফ্লাইটটি অবতরণ করল। অ্যারোপ্লেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো করোনার পিসিআর টেস্টের জন্য। গ্রিস সরকারের এ উদ্যোগটি আমার কাছে ভালো লেগেছে। বাইরের দেশ থেকে কেউ গ্রিসে প্রবেশ করলে সে দেশের সরকারি খরচে তার জন্য করোনার পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়।
ইমিগ্রেশন ডেস্কে আমাদের সঙ্গে গ্রিসে পা রাখা সব যাত্রীর মুখের থেকে লালা নিয়ে করোনার টেস্ট করা হলো। পাশাপাশি আমাদের সবাইকে এক দিনের জন্য আইসোলেশনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। ভিয়েনার মতো গ্রিসেও এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অর্থাৎ যেখানে একসঙ্গে অধিক মানুষ একত্র হয়, এমন জায়গাগুলোতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। তবে থেসালুনিকির এয়ারপোর্টে সেভাবে মানুষের পদাচারণ ছিল না বললেই চলে।
এয়ারপোর্টে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাইরে বের হতে হতে বিকেল চারটা বেজে গেল। গ্রিসের সঙ্গে স্লোভেনিয়ার সময়ের পার্থক্য এক ঘণ্টা। গ্রিস যে সময়ের দিক থেকে স্লোভেনিয়াসহ মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় এক ঘণ্টা এগিয়ে, সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি থেসালুনিকির সিটি সেন্টারে পৌঁছানোর জন্য বাস সার্ভিস রয়েছে। বাস নাম্বার হচ্ছে X1; এয়ারপোর্ট থেকে থেসালুনিকির সিটি সেন্টারে যেতে ১৮০ ইউরোর মতো ভাড়া লাগে।
আপনাদের চোখে যদি ইউরোপের সংজ্ঞা হয় গ্রেট ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক কিংবা নরওয়ে, তাহলে গ্রিসে আসলে আপনাকে হতাশ হতে হবে। অবকাঠামোগত দিক থেকে গ্রিসের সঙ্গে বলকান অন্যান্য দেশের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গ্রিসের রাস্তাঘাট, দালানকোঠা কিংবা গণপরিবহনের দিকে তাকালে কোনোভাবে মনে হবে না যে এটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কোনো রাষ্ট্র। জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন,নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া—এসব দেশের রাস্তাঘাট যেমন প্রশস্ত, তেমনি পরিকল্পিত ও পরিচ্ছন্ন। এসব দেশের অধিবাসীরাও আইনের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল।
বলকান রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা একেবারে বিপরীত। এসব দেশের রাস্তাঘাটের চেহারা অনেকটা রুগ্ণ প্রকৃতির, পরিচ্ছন্নতার বালাই সেখানে খুব একটা চোখে পড়বে না। মানুষও আইন মেনে চলার ব্যাপারে তেমন একটা সচেতন নয়। গ্রিসের ক্ষেত্রেও দেখলাম বিষয়গুলো একই।
গ্রিসের অধিবাসীরা ট্রাফিক আইন সেভাবে মেনে চলে না। গ্রিসে মাথাপিছু হিসাব করলে প্রায় সবার নিজস্ব গাড়ি আছে এবং তাদের বেশির ভাগ শহরে গাড়ি পার্ক করতে চাইলে কোনো ধরনের পার্কিং ফির প্রয়োজন হয় না। মানুষজন তাই যেখানে–সেখানে গাড়ি পার্ক করে রাখে। অনেক সময় এ কারণে ঢাকা শহরের মতো এথেন্স কিংবা থেসালুনিকির মতো বড় শহরের বিভিন্ন এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়।
থেসালুনিকিতে দেখলাম যে যার মতো পারছে গাড়ি ড্রাইভ করছে, ট্রাফিক সিগন্যালের দিকে কারও তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। রাস্তা পারাপারের সময়ও দেখলাম পথচারীরাও ট্রাফিক সিগন্যাল কিংবা জেব্রা ক্রসিং কোনো কিছুর ধার ধারছে না। অনেককে দেখলাম আবার ফুটপাতের ওপর দিয়ে পারলে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেয়। গ্রিস কিংবা বলকান দেশগুলো সত্যি আজব! ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত হওয়া সত্ত্বেও বলকান রাষ্ট্রগুলো কেন জানি ইউরোপ নয়। আবার গ্রিসে গণপরিবহনগুলোতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে মাস্ক পরিধান করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক হলেও অনেককে দেখলাম সে বিষয়ে খুব বেশি একটা কর্ণপাত করছেন না।
নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, ফ্রান্সসহ ইউরোপের প্রায় সব দেশের মানুষের চেহারার গঠনে একধরনের সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। গ্রিসে তেমনটা লক্ষ করা যায় না। কেউ দেখতে তুর্কিদের মতো, কারও চেহারা আবার আরবদের মতো, কেউ আবার স্লাভিকদের মতো ফরসা ও সোনালি চুলের অধিকারী, কেউবা দেখতে আবার ইতালিয়ান কিংবা স্প্যানিশদের মতো।