দেশের সর্বোচ্চ বিন্দু খুঁজেছেন এক দশক ধরে, হারিয়েছেন তিন সহযাত্রীকে

দেশের ৩ হাজার ফুট বা তার চেয়ে উঁচু ১৮টি পাহাড়চূড়া মাপার অভিযানে নেমেছিলেন তরুণ পর্বতারোহী সালেহীন আরশাদী। কাজটা শেষ করতে তার এক দশক লেগে গেল। এর মধ্যে হারিয়েছেন তিন সহযাত্রীকে, নিজেও গুরুতর আহত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন বছরখানেক। সালেহীনের অভিযানের গল্প শুনলেন সজীব মিয়া

অভিযানের উত্তেজনায় রাতে ভালোমতো ঘুম হয়নি। তবু অ্যালার্ম বেজে উঠতেই কম্বলের ওম ছেড়ে উঠে পড়তে হলো। আলো ফোটার আগেই হাতিছড়াপাড়া থেকে বেরিয়ে পড়তে হলো। সদ্য জমতে থাকা ঘুম ঘুম ভাবটুকু শীতের দাপটে উবে গেল। বাইরে তখনো কৃষ্ণপক্ষের জমাট অন্ধকার। কুয়াশা তার রহস্যের চাদর দিয়ে পুরো পাহাড়কে ঘিরে রেখেছে। পাহাড়জুড়ে নিস্তব্ধতা। সহ–অভিযাত্রী ইমরান খান ও স্থানীয় গাইড কৃষ্ণ ত্রিপুরা পথে নেমেই ছুটতে শুরু করল। কুয়াশার ফাঁক দিয়ে ইমরানের হেডল্যাম্পের আলো আবছায়া জোনাকির মতো পাহাড়ি পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘোরের মধ্যে সেই আলোটুকু অনুসরণ করে যাচ্ছি। সব নীরবতাকে খান খান করে পাশের বন থেকে তারস্বরে চিৎকার করে ডেকে উঠল একটা মায়া হরিণ। হঠাৎ বিকট আওয়াজে আমার ঘোর কেটে গেল। অনেকক্ষণ পর স্থান-কাল সম্পর্কে সচকিত হয়ে উঠলাম

উচ্চতা মাপার অভিযানের সময় কোনো এক দুর্গম পাহাড়ে
ছবি: সংগৃহীত

এক দশকের বেশি আগে দেশের ৩ হাজার ফুট উচ্চতার ১৮টি পাহাড়চূড়া সশরীর মাপার যে অভিযানের শুরু করেছিলাম, সম্ভবত আজ তার সমাপ্তি হচ্ছে। রাঙামাটির বিলাইছড়ির দুর্গম অঞ্চলে ১৮ নম্বর পাহাড়টিতে উঠতে যাচ্ছি আমরা। উত্তেজনা চেপে জিপিএস যন্ত্র হাতে গন্তব্যের দিকে ছুটছি। একসময় আলো ফুটল। দিনের আলোয় কুয়াশামোড়া পাহাড়ও চোখ মেলল।

এক দশকের এই অভিযানে নেমে প্রতি পদে কত কত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে—রোদ, ঝড়, বৃষ্টির সবচেয়ে তীব্র রূপ দেখা; হড়কাবানে রাক্ষসী রেমাক্রি পার হওয়ার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা; ভাদ্রের তালপাকানো গরমে পাহাড়ের ওপরে বসে এক ফোঁটা পানির জন্য হাহাকার; গভীর জঙ্গলে পথ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে যাওয়া; বুনো গিরিখাদে দুই দিন আটকা পড়া; হাইপোথার্মিয়ার ভয়ে বৃষ্টিতে ভেজা কাঁচা বাঁশ দিয়ে সারা রাত আগুন জ্বালিয়ে রাখা...।

নাইক্ষ্যাং খুম পাড়ি দিতে নিজেরাই বানালেন বাঁশের ভেলা

এমন স্মৃতি পুঁজি করেই একসময় আমরা উঠলাম মুখরা থুতাই হাফংয়ের চূড়ায়। হাতের যন্ত্রের তথ্য-উপাত্ত জানান দিল, পাহাড়ের উচ্চতা ৩১৫৬ ফুট। দিনটা ছিল ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি।

অভিযানের অনুপ্রেরণা

নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার দেওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে বান্দরবানে গিয়েছিলাম। সেই যে পাহাড়ের মায়ায় আটকা পড়লাম, দিন দিন তা যেন বাড়তেই থাকল। একসময় বাংলাদেশের পাহাড় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। ফেসবুকে বাংলাট্রেক নামে একটা গ্রুপের খোঁজ পেলাম। বাংলাট্রেকে বাংলাদেশের কিছু পাহাড় চূড়ার একটি অসমাপ্ত তালিকা দেখেই মাথায় চিন্তা এল, যে করেই হোক, এই তালিকা সম্পূর্ণ করতে হবে। তখন আমি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসিতে অনার্স করছি।

সাকা হাফংয়ের চূড়ায়, ২০১১

রাতের পর রাত কেটে গেল গুগল আর্থ, সোভিয়েত টপো ম্যাপ, আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ প্রদত্ত মানচিত্র, ব্রিটিশ আমলে পরিচালিত গ্রেট টিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের মানচিত্র, নাসার স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া এসটিএম ডেটা ঘেঁটে। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিলাম। একসময় কাগজে–কলমে বাংলাদেশের তিন হাজার ফুট বা তার চেয়ে উঁচু স্থানগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হলো। ইতিমধ্যে ফেসবুকভিত্তিক ভ্রমণ প্ল্যাটফর্ম ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ ও ডি-ওয়ে এক্সপেডিটর্সের সঙ্গেও পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় তারাও আমার মতোই দেশের পাহাড়-পর্বতে আনকোরা জায়গা খুঁজে বেড়ানোর আলাদা অভিযান চালাচ্ছিল।

প্রথম অভিযান

কাগজে–কলমে মানচিত্রে কোনো স্থান চিহ্নিত করা এক বিষয়, আর সশরীর গিয়ে সেই স্থান আসলেই কতটুকু উঁচু, তা পরিমাপ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কারণ, সব কটি স্থান বান্দরবান-রাঙামাটির দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত।

২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম অভিযানে গেলাম ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশ ও ডি-ওয়ে এক্সপেডিটর্সের নয়জনের দলে ভিড়ে। বয়সে আমি সবার ছোট। সে অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল বাকতলাই জলপ্রপাতের উৎস সন্ধান। সে কাজ সম্পন্ন করে দলেবলে ছুটলাম লাখু ডং পাহাড়ের চূড়ায়। বান্দরবানের রুমা উপজেলার ৩০৭৭ ফুট উচ্চতার এই পাহাড় পরিমাপের মাধ্যমে শুরু হলো আমার অভিযান।

যন্ত্রের নাম গারমিন ইট্রেক্স ২০

যেভাবে উচ্চতা মাপা হয়েছে

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্থানগুলোর উচ্চতা পরিমাপের জন্য কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক দিকনির্ণয় পদ্ধতি (নেভিগেশনাল সিস্টেম) ব্যবহার করেছি। সর্বোচ্চ শুদ্ধতা নিশ্চিতকরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ও রুশ মহাকাশ সংস্থার গ্লোনাস স্যাটেলাইট সিস্টেম একসঙ্গে ব্যবহার করেছি। এ কাজে গারমিন ইট্রেক্স ২০ ও জিপিএস ম্যাপ ৬৪ এস যন্ত্র দুটি ব্যবহার করেছি। কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক এই দিকনির্ণয় পদ্ধতির সাহায্যে কোনো নির্দিষ্ট স্থানের অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, উচ্চতা, দূরত্ব প্রভৃতি অবস্থানগত তথ্য যথাযথভাবে তুলে আনতে সব সময় সাবধানতা অবলম্বন করেছি। পাহাড়ের ওপরটা গাছপালায় ঢাকা থাকার কারণে স্যাটেলাইটের সিগন্যাল যেন কোনো রকম বাধা না পায়, তার জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটি পরিষ্কার করে নেওয়া হয়েছে। প্রতি মিনিটে চারটি করে সর্বনিম্ন মোট আধা ঘণ্টা ধরে উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। এরপর সব উপাত্তের গড় করে সেটা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাপ্ত উপাত্তগুলো পুরোনো মানচিত্র ও আধুনিক আরএসটিএম তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এরপরও স্যাটেলাইটনির্ভর দিকনির্ণয়ে কিছুটা ত্রুটি থেকেই যায়। আমাদের সংগৃহীত উপাত্তের নির্ভুলতা তিন মিটার কমবেশি হতে পারে।
গহীন পাহাড়ে একটু জিরিয়ে নেওয়া

ভুলি নাই

এর মধ্যেই একটা দুর্ঘটনা আমাদের জীবনটা লন্ডভন্ড করে দিল। সময়টা ২০১২ সাল। মদক রেঞ্জের ৩২৫২ ফুট উচ্চতার যোগী হাফং অভিযান শেষে থানচি হয়ে ফেরার পথে আমাদের বহনকারী বাসটি ৫০০ ফুট নিচের খাদে পড়ে যায়। দুর্ঘটনায় পর্বতারোহী তাশদীদ রেজওয়ান, তারিকুল আলমসহ প্রায় ৩২ জন যাত্রী মারা যায়। আমি আর শাহ মইনুল ইসলাম ভাই মারাত্মক আহত হই। আমার দুই পায়ের হাড় ও মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। মইনুল ভাইয়ের পায়ে চলল একের পর এক অপারেশন। গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যাওয়া হাড়ের বদলে লাগানো হলো টাইটেনিয়ামের প্লেট।

৩ বছর পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়েই আবার পাহাড়ে ছুটলাম। কিন্তু আমার জন্য আরেকটি ধাক্কা অপেক্ষা করছিল। ২০১৫ সালের জুনে রাঙামাটির বিলাইছড়ির ৩৩১৭ ফুট উচ্চতার দুমলং পাহাড়চূড়া অভিযান শেষে ঢাকায় ফিরে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলো ছোটবেলার বন্ধু শেখ সেরাজুম মুনীর। চোখের সামনে তাঁকে মারা যেতে দেখলাম।

রেং ত্‌ল্যাং অভিযানে দলটির সবাই আছেন, শুধু নেই শেখ সেরাজুম মুনীর (সর্ববাঁয়ে)

প্রতিজ্ঞাবদ্ধ

বন্ধুকে হারিয়ে তীব্র অভিমানে একটি লম্বা সময় অভিযান থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। একসময় মনে হলো, যাদের নিয়ে অভিযান সম্পূর্ণ করার চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম, তাদের জন্য হলেও তালিকাটি সম্পূর্ণ করার চেষ্টা আমাকে করে যেতে হবে। চাকরি ছেড়ে তত দিনে পুরোদস্তুর অভিযাত্রিক হয়ে গেছি। অবশেষে ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি সব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে মুখরা থুতাই হাফংয়ে আরোহণ করলাম।

কাজ কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এই পর্বতগুলোর গুরুত্ব, বিচ্ছিন্নতা, জলনিষ্কাশনব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্য, মানুষ ও সংস্কৃতি নিয়ে আরও তথ্য জোগাড় করার আছে। তাই পাহাড় যেন পরবর্তী অভিযাত্রীদের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে।

জো ত্‌ল্যাং অভিযান শেষে (বাঁ থেকে) তারিকুল ইসলাম, শাহ মইনুল ইসলাম, তাশদীদ রেজওয়ান, লিলিয়ান ও সালেহীন আরশাদী। এর মধ্যে তারিকুল ও তাশদীদ এখন শুধুই ছবি, ২০১২

কোন পাহাড় কত উঁচু

১৮টি পাহাড়চূড়ার মধ্যে বান্দরবানে পড়েছে ১৩টি আর রাঙামাটিতে ৫টি। তবে এই ১৮ পর্বতের কয়েকটিকে গুরুত্ব ও বিচ্ছিন্নতার বিবেচনায় চূড়া বা শিখর বলা যায় না। তাই ৩ হাজার ফুটের বেশি উঁচু ১৮টি পর্বতকে আমরা ‘দেশের সর্বোচ্চ স্থান’ হিসেবে বিবেচনা করছি। উচ্চতার ক্রম অনুসারে স্থানগুলো হলো—সাকা হাফং ৩৪৭৭ ফুট, জো ত্‌ল্যাং ৩৩২৫, দুমলং ৩৩১৭, যোগী হাফং ৩২৫২, কেওক্রাডাং ৩২৩৪, মাইথাইজামা হাফং ৩১৭০, মুখরা থুতাই হাফং ৩১৬৫, খিনদোলতে ত্‌ল্যাং ৩১৪৯, হাজাছড়া হাফং ৩১৩৩, কপিটাল ৩১২০, রেং ত্‌ল্যাং ৩১০৩, ক্রেইকুং তং ৩০৯৩, সাদরা হাফং ৩০৮৩, লাখু ডং ৩০৭৭, তং মে ৩০৭৪, তাওবহ হাফং ৩০৫৭, লাইস্রা হাফং ৩০২৮ এবং সিপ্পি আরসুয়াং ৩০০৫ ফুট।

গুগল আর্থে ১৮টি পাহাড়চূড়া