মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী
১০ মিনিট পর হানাদাররা বলল, এখনো দোয়া শেষ হয় নাই?
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো।
সংগ্রহকারী: মো. অসিউজ্জামান, সপ্তম শ্রেণি, আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গা
বর্ণনাকারী: খাদিজা খাতুন, চুয়াডাঙ্গা
সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: নাতি-নানি
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম মুচাইনগর গ্রামে। সেই গ্রামের মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অনেক নির্যাতন করেছিল। তারা মানুষের ঘরবাড়ি, জমির ফসল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের কর্মক্ষেত্র জ্বালিয়ে শেষ করে দিয়েছিল। তখন কেউ রুখে দাঁড়ালেই অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিত, নয়তো পানির মধ্যে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারত।
তখন ওই গ্রামের অনেক মানুষ অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গ্রাম থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর যাঁরা হানাদারদের অত্যাচার সহ্য করে গ্রামে থাকতেন, তাঁদের মধ্যে কেউ হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ কেউ না খেয়ে।
আমার বাবা মুবারেক মুন্সী গ্রামের অসহায় মানুষদের জন্য রাতের অন্ধকারে খাবার নিয়ে যেতেন। তিনি হানাদারের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন বলে আমরাও নির্যাতনের শিকার হয়েছি। বাজারে আমাদের বড় দোকান ছিল। সেই দোকান হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। তখন শুরু হয় মহাদুর্ভোগ।
তারপরও বাবা অত্যাচার সহ্য করে পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এবং দেশ স্বাধীন করার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিতেন বাবা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোথায় অবস্থান করছে, কোন দিক থেকে আসছে—বাবার দেওয়া এসব তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের আক্রমণ করতেন, রক্ষা করতেন সাধারণ–নিরীহ মানুষদের।
একসময় পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। মুচাইনগর গ্রামের মানুষকে মারতে তো লাগলই, গ্রামের যুবতীদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে লাগল নৃশংসভাবে। তখন আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে খবর দেন। মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক করেন, মুচাইনগর গ্রামকে হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
একদিন মুক্তিযোদ্ধারা সুযোগ বুঝে হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালায়। হানাদাররা সংখ্যায় ছিল অনেক বেশি আর তাদের ছিল অনেক ভারী অস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন কম এবং তাঁদের কাছে তেমন কোনো অস্ত্র ছিল না। তাই তাঁরা সেখানে পরাজিত হন।
কিছুদিন পর হানাদাররা জানতে পারে, বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দেন। তাই তারা বাবাকে ধরে নিয়ে যায় এবং গ্রামের মানুষের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। হানাদাররা তাঁকে মারার জন্য হাঁটুপানিতে নামায়।
বাবা তখন হানাদারদের বলেন, আমার ছয় মেয়ে, এক ছেলে। তাদের জন্য দোয়া করতে দাও, তারপর মেরো।
হানাদারদের দোসর যে রাজাকার ছিল, সে বাবাকে চিনত। সে হানাদারদের বলে, তাকে এই সুযোগটা দিন।
তখন বাবা আমাদের জন্য দোয়া করতে শুরু করেন। কিন্তু দোয়া করা শেষ হয় না। ১০ মিনিট পর হানাদাররা বলে, এখনো দোয়া শেষ হয় নাই?
আমাদের সাহসী বাবা বলেন, আমার সাতটা ছেলেমেয়ে, তাদের সবার জন্য দোয়া করব, একটু সময় তো লাগবেই।
তখন এক হানাদার সদস্য বাবার কাছে থাকে, বাকিরা চলে যায় খেতে। ওই একজন হানাদার বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে, বাবার দোয়া শেষ হলেই গুলি করে মেরে ফেলবে।
এদিকে মন্টু নামের একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা খবর পান, মুবারেক মুন্সী অর্থাৎ আমার বাবাকে হানাদাররা ধরে নিয়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা মন্টু আমার বাবাকে হানাদারদের হাত থেকে রক্ষার জন্য ঘটনাস্থলে ছুটে যান। আড়াল থেকে দেখতে পান, হানাদার সদস্যটি বন্দুক হাতে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর বাবা দুই হাত তুলে দোয়া করছেন।
তখন মুক্তিযোদ্ধা মন্টু হানাদার সদস্যটির মাথায় গুলি করেন। সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় সে। মুক্তিযোদ্ধা মন্টু সেখান থেকে বাবাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন।
তবে বাবা হানাদারদের হাত থেকে রেহাই পেলেও গ্রামের লোকজনদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ক্রমেই বাড়তে লাগল। গ্রামের অনেকেই প্রাণ হারালেন।
কিছুদিন পরে এল সেই মহান দিন—১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেদিন পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করল। মানুষ পেল মুক্তির স্বাদ।