চোখের আলো ফিরে পেলে সবার আগে মা–বাবাকে দেখতাম, বললেন জিপিএ–৫ পাওয়া বগুড়ার নাজীফা
‘যদি কখনো চোখের আলো ফিরে পাই, সবার আগে মা-বাবাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখব। তাঁরাই তো আমার সুপারম্যান,’ বলেন নাজীফা তাসনিম।
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের মানবিক শাখার এই শিক্ষার্থী এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে এ প্লাস (গোল্ডেন জিপিএ–৫) পেয়েছেন। থাকেন বগুড়ার জলেশ্বরীতলায়। জন্ম থেকেই তাঁর চোখে আলো নেই। তবু শ্রুতলেখকের সহায়তায় পরীক্ষা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন নাজীফা। শুধু যে পড়ালেখায় ভালো তা নয়, গানের জগতেও নাজীফার আছে দারুণ কিছু সাফল্য।
সুপারম্যান
নাজীফার বাবা ওবায়দুল্লাহ লিটন সিরাজগঞ্জের কাজীপুর আঞ্চলিক মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, মা জান্নাতুল ফেরদৌস গৃহিণী। সন্তানের জন্মের পরপরই তাঁরা জানতে পারেন, মেয়ের দুচোখে আলো নেই। তবু কখনো হতাশ হয়ে যাননি। এ কারণেই হয়তো মা-বাবা নাজীফার কাছে ‘সুপারম্যান’।
মায়ের মুখে শুনে শুনে বর্ণমালা শেখা শুরু। পরে ভর্তি হন বগুড়ার ধুনটের ভরনশাহী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর চলে যান সেনাবাহিনী পরিচালিত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতিষ্ঠান ‘প্রয়াস’-এ। সেখান থেকেই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। এরপর গোপালনগর ইউএকে উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ২০২৩ সালে এসএসসিতে বৃত্তিসহ জিপিএ-৫ পান।
সংগীতের স্বপ্নে
দেশাত্মবোধক গানে ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে স্বর্ণপদক পেয়েছেন নাজীফা। ২০২২ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহেও হয়েছেন দেশসেরা। বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীতশিল্পী। গাওয়ার পাশাপাশি নিজেই গান লেখেন, সুর করেন। বাজাতে পারেন গিটার, হারমোনিয়াম, তানপুরা, ইউকেলেলে, বাঁশি আর একতারা।
২০১৬ সালে চ্যানেল আইয়ের ‘খুদে গানরাজ’-এ সেরা ১৯, আর ২০১৭ সালের ‘গানের রাজা’-প্রতিযোগিতায় সেরা ১২ পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। পরের বছর কচিকাঁচার মেলা আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান প্রতিযোগিতায় জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন তিনি।
আলো খোঁজা
নাজীফা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই শুনে শুনে গান গাইতাম। ইউটিউবে শুনে নিজে নিজে শিখেছি। বাবা সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন। বাদ্যযন্ত্র কিনে দিয়েছেন। পরে ওস্তাদ বেলাল হোসেন ও ওস্তাদ আবদুল আউয়ালের কাছে গান শিখেছি। উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নিই ওস্তাদ মুরাদ সিদ্দিকীর কাছে।’
বাবা ওবায়দুল্লাহ লিটন বলেন, ‘মেয়ের চোখে আলো ফেরাতে দেশে-বিদেশে বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু কাজ হয়নি। তবু নাজীফা কখনো হার মানেনি। ক্লাসে শিক্ষকের লেকচার রেকর্ড করে বাসায় এসে মনোযোগ দিয়ে শুনত। ইউটিউবের ভিডিও কাজে লাগিয়ে নিজে নিজে শিখত। তার এই সাফল্যে আমি গর্বিত।’
অন্তর্দৃষ্টিই বড়
নাজীফার ফল দেখে ভীষণ খুশি কলেজের শিক্ষকেরা। বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোস্তফা কামাল সরকার বলেন, ‘নাজীফার দৃষ্টিশক্তি নেই, কিন্তু তার অন্তর্দৃষ্টি অসাধারণ। ক্লাসে শিক্ষকের কথা শুনে শুনেই অনেক বিষয় বুঝে ফেলে। তার একাগ্রতা ও ইচ্ছাশক্তি বিস্ময়কর। আলোহীন চোখেও সে যেভাবে সাফল্য অর্জন করেছে, সেটি সবার জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।’
ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন নাজীফা। পাশাপাশি দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ারও ইচ্ছা আছে তাঁর।