রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলাম, এখন আছি যুক্তরাজ্যে

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ)–এর ১০ শিক্ষার্থীকে প্রতিবছর ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি দেয় প্রথম আলো ও আইডিএলসি। শুধু এটিই নয়, সুবিধাবঞ্চিত আরও বহু নারীকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে চট্টগ্রামের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেমন ‘তৈরি পোশাকশিল্প’ খাত থেকে এ পর্যন্ত ১২৩ জন আন্তর্জাতিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন মনিকা দাস। হাজারো বাধা পেরিয়ে সাফল্যের দেখা পাওয়া এই নারীর কথা নিশ্চয়ই আরও অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হবে। অনুলিখন করেছেন জিনাত শারমিন

মনিকা দাস
ছবি: সংগৃহীত

উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত জীবনটা একরকম নির্বিঘ্নেই কেটেছিল। বাবা পাসপোর্ট অফিসে চাকরি করতেন, মা গৃহিণী। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় দুই ভাইয়ের আমি ছিলাম একমাত্র ছোট বোন।

২০১৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েও হইনি। কারণ, ইচ্ছা ছিল অর্থনীতিতে পড়ব; কিন্তু পরের বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সই পেলাম না। অর্থনীতিতে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলাম বটে; কিন্তু মন টিকছিল না। দু-এক দিন গিয়ে গেলাম না আর।

এর মধ্যে আচমকা বাবা স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুদিন পর ২০১৬ সালে তিনি মারা যান। বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর উপার্জনক্ষম বড় ভাই বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেলেন। ছোট ভাই তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। উপায় না পেয়ে তাকে পড়াশোনা ছাড়তে হলো। স্বর্ণকারের কাজ শিখে মা, বোনসহ পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিল।

একপর্যায়ে পুরো পরিবার আমার বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগল; কিন্তু আমি তো স্নাতক শেষ না করে বিয়ে করতে চাই না। ঘরের মানুষদের সঙ্গে আর কাঁহাতক লড়াই করা যায়? ২০১৬ সালের নভেম্বরে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। প্রথমে ঠিকানা হলো এক বান্ধবীর বাসায়। ওই বান্ধবীর বড় বোন-দুলাভাই ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করত। বান্ধবীর সঙ্গে ঢাকায়, ওর বোনের বাসায় চলে এলাম। ঢুকে পড়লাম গার্মেন্টসে, কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর। আমাদের পরিবারে বা চেনাজানা আত্মীয়স্বজনের ভেতরে কেউ কখনো গার্মেন্টসে কাজ করেনি। কী যে কষ্ট, আর ওখানকার মেয়েদের একেকজনের জীবনের সে কী সংগ্রাম! সত্যি বলতে, ওখানে বেশি দিন টিকতে পারতাম না। সৃষ্টিকর্তা বোধ হয় বুঝেছিলেন, তাই চাকরির ১০ দিনের মাথায় এইউডব্লিউর বৃত্তির খোঁজ পেলাম। পরীক্ষা দিলাম, সুযোগও হয়ে গেল। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে পা রাখলাম ক্যাম্পাসে।

ডর্মে গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। থাকা, খাওয়া ও পড়াশোনার সুযোগ তো ছিলই, মাসে মাসে একটা বৃত্তিও পেতাম। এ ছাড়া ফল ভালো ছিল বলে প্রায় প্রতিটি সেমিস্টারেই টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে শিক্ষকদের সঙ্গে কাজ করতাম। প্রকল্পভিত্তিক কাজের সুযোগও আসত। যেমন কর্ণফুলী ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় মেয়েদের পড়ানো, উপাত্ত সংগ্রহ ইত্যাদি। বাসায় তো আর টাকা পাঠানো লাগত না, ছোট ভাই মাকে দেখছিল। আমার ভালোই চলে যেত। ভালো রেজাল্ট নিয়ে স্নাতক শেষ করলাম। তারপর বিয়ে করলাম।

আরও পড়ুন

স্নাতকের সময়ই ঠিক করেছিলাম, দেশের বাইরে যাব। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম ছিল প্রথম পছন্দ। কিন্তু সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর ওরা আমাকে ৫০ শতাংশ বৃত্তির প্রস্তাব দিল। বাকি ৫০ শতাংশও অনেক। প্রায় ৩০ লাখ টাকা! আমার পক্ষে বহন করা অসম্ভব।

যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে পড়াশোনা করা শুরু করলাম। দেখা গেল, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসের টিউশন ফি তুলনামূলক কম। ওখানে আবেদন করলাম। ওরা ৩ হাজার পাউন্ড বৃত্তি দিল। বাকি ছিল ১৪ হাজার ৫০০ পাউন্ড। এই টিউশন ফির অর্ধেকটা জমা দিয়ে তারপর যেতে হবে।

মার্কিন ব্যবসায়ী স্যাম গিলানি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেককেই সহযোগিতা করেন, বিশেষ করে যাঁদের বাবা নেই। বাইরে পড়তে আসার সময় তিনিই প্রথম অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করলেন। সঙ্গে যোগ হলো আমার শ্বশুরবাড়ির পরিবার, ভাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কামাল আহমদ—সবার সহায়তা। বাকিটা আমি এখানে এসে প্রতি মাসে একটু একটু করে শোধ করেছি। এখন আমি আর আমার স্বামী, দুজনই যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে আছি। ভাগ্যিস, স্পাউস ভিসায় জীবনসঙ্গীকে নিয়ে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা আসার পরপরই এই সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আমার স্বামী শুরু থেকেই এ দেশে চাকরি করছেন।

ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলস থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে মাস্টার্স করেছেন মনিকা
ছবি: সংগৃহীত

ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলস থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে মাস্টার্স করেছি। এখন আছি পোস্ট স্টাডি ওয়ার্ক ভিসায়। একটি হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করছি। আমরা এখানেই থিতু হতে চাই।

এখন পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, জীবনে অনেক কিছুই না ভেবে করে ফেলেছি। বাড়ি ছেড়েছিলাম শুধু ওই বয়সে বিয়ে করতে চাইনি বলে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে; কিন্তু জীবন আমাকে উদার হস্তে দিয়েছে। অল্প বয়সে মানুষ চিনেছি। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি বারবার। তবু সৎভাবে বাঁচার চেষ্টা করেছি। এখন মনে হয়, যে জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলাম, ঠিক তেমন একটা জীবনই আজ যাপন করছি।

আরও পড়ুন