বাবা মুড়ি বিক্রি করতেন, অভাব ছিল, কিন্তু দমিনি

সত্যজিৎ চন্দ্র রায়ছবি: দীপু মালাকার

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর কালীবাড়ী গ্রামের অতি সাধারণ পরিবারের ছেলে আমি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে উঠেছি। বাবা মুড়ি বিক্রেতা, মা গৃহিণী। বাবা হাটে-বাজারে গভীর রাত পর্যন্ত মুড়ি বিক্রি করতেন। আমরা তিন ভাই।

পরিবারে বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। আমরা পড়াশোনায় ভালো, প্রতিটি ক্লাসের পরীক্ষায় প্রথম হই। আমি প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হইনি।

গ্রামের লোকেরা ঈর্ষা করত, বাবাকে নানা কটু কথা শোনাত। মুড়ি বিক্রেতার ছেলেরা পড়াশোনায় ভালো করছে—এটা বোধ হয় কেউ কেউ ভালোভাবে নিতে পারেনি।

কিন্তু স্কুলের শিক্ষকেরা বাবাকে বলতেন, ‘আপনার ছেলেরা লেখাপড়ায় ভালো করছে, আপনি লেগে থাকুন। ওরা একদিন ভালো কিছু করবে।’

সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় আমি প্রথম হই, গোটা স্কুলে সর্বোচ্চ নম্বর পাই। বাবার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটি নোট বের করে দেন বাবা। টাকা পেয়ে আমি খুব খুশি। তার চেয়ে বেশি খুশি এই ভেবে যে সে বাবার দিন-রাতের পরিশ্রম কিছুটা সার্থক করতে পেরেছি। 

যাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ

আমরা তিন ভাই যতই ওপরের ক্লাসে উঠতে থাকে, বাবার দুশ্চিন্তা ততই বাড়ে। কারণ, তাঁর বিক্রিবাট্টা ভালো চলছিল না। অনেকে পরামর্শ দিল, ছেলেদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে কৃষিকাজে লাগাও। কিন্তু বাবা কারও কথা শোনেননি; যতই কষ্ট হোক, আমাদের পড়াশোনার খরচ দিয়ে গেছেন।

এসএসসিতে আমি জিপিএ-৫ পাই। আমাকে নিয়ে লেখা ছাপা হয় প্রথম আলোয়। দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ায় ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল। আমার স্বপ্ন বিকাশের পথে এ এক নতুন দিগন্ত, এক নতুন প্রাপ্তি।

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নতুন প্রত্যয়ে এগিয়ে চলি। আমার লক্ষ্য, ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রথম আলোর দেওয়া সহযোগিতার মান রক্ষা করা।

কলেজে আমার শিক্ষক জামিল স্যার, মতিউল স্যার, মতিন স্যার, শেলী ম্যাডামের সহযোগিতায় উচ্চমাধ্যমিকেও গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাই। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী তহবিল আমার জন্য বৃত্তি অব্যাহত রাখে। উচ্চমাধ্যমিকের পর ভর্তি হই রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগে। 

আরও পড়ুন

আঁধার শেষে আলো

২০১৭ সালে স্নাতক সম্পন্ন করি। প্রভিশনাল সার্টিফিকেট (পিভিসি) হাতে পাই ২০১৮ সালে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে চাকরির খোঁজে আসি ঢাকায়। এক পরিচিত বড় ভাইয়ের মেসে থাকার ব্যবস্থা হলো। সেখান থেকে শুরু লক্ষ্য পূরণে ছোটাছুটি। সরকারি চাকরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাই তখন একমাত্র লক্ষ্য।

কিন্তু মেসের খরচ, চাকরিতে আবেদনের খরচ মেটাতে তো টাকা দরকার। টিউশন খুঁজতে হলো। অবশেষে এক বন্ধুর মাধ্যমে এক টিউশনের বন্দোবস্ত হলো, তাতে মাসে পাব পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু তা দিয়ে তো ঢাকা শহরে থাকা, খাওয়া, চাকরির আবেদন ইত্যাদির খরচ মেটানো সম্ভব নয়। আরেক বন্ধুর দ্বিতীয় টিউশনটির ব্যবস্থা করে দিল। দুটি মিলিয়ে কোনোরকমে থাকা, খাওয়া ও চাকরির আবেদন করার খরচ জোগাড় হলো।

নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে ২০১৯ সালে যোগ দিই নৌপরিবহন অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালক হিসেবে। ২০২২ সালে যোগ দিই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অধীন জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (এনএসডিএ)। ৪৪তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই এবং সম্প্রতি ৪৫তম বিসিএসের ভাইভাও দিয়েছি।

আরও পড়ুন

বৈষম্য যেখানে

শৈশব-কৈশোর বা বেড়ে ওঠার সময় বেশ কিছু বৈষম্যের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। তাই এই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, শহরের তুলনায় গ্রামে ভালো খাবার, পোশাকের অভাব তো আছেই। পাশাপাশি ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ভালো শিক্ষকের সংকট অন্যতম সমস্যা।

আমরা কাছের মানুষদের কাছ থেকে সুপরামর্শও পাইনি। যেমন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায়, কোন বিষয়ে পড়লে লাভ—এসব পরামর্শ আমি অন্তত পাইনি। আত্মীয়স্বজন হয়তো ভাবতেন, আর্থিক সহায়তার জন্য এসব প্রশ্ন করছি। ঢাকায় যখন প্রথম আসি, তখন কোথায় থাকলে ভালো হয়, কোন কোচিংয়ে ভর্তি হওয়া যায়, এসব বিষয়ে পরামর্শের জন্য অনেকের কাছে গিয়েছি, কেউ পরামর্শ দিয়েও পাশে দাঁড়াননি।

কিছু পরামর্শ

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চলছে। এখন নিজের কর্মদক্ষতাই বড় সম্বল। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি। প্রথমত, পড়াশোনার বিকল্প নেই। বই আপনাকে পড়েতেই হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময়ের অপচয় মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই আবার হয়ে উঠতে পারে নিজের উন্নতির হাতিয়ার।

খেলাধুলা, বিতর্ক, নাচ, গানের চর্চা আপনাকে এগিয়ে রাখবে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিন, যা নিজের বিকাশে অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক প্রযুক্তি যত দ্রুত আয়ত্ত করবেন, ততই এগিয়ে থাকবেন।

মা-বাবার কষ্টার্জিত টাকার সঠিক ব্যবহার করুন। আত্মোন্নয়নে সচেষ্ট থাকুন। যাঁরা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী, তাঁরা গবেষণায় আগ্রহী হোন এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান দেশের উন্নয়নে কাজে লাগান। হতাশ না হয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেকে শাণিত করুন। কর্মচিন্তা না করে কর্ম তৈরির চিন্তা থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তাও হতে পারে আপনার পথ।

সব শেষে একটাই চাওয়া, বাংলাদেশ গড়ে উঠুক দক্ষ, মেধাবী, নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন একটি মানবিক ও উন্নত জাতি হিসেবে।

সত্যজিৎ চন্দ্র রায়, সহকারী পরিচালক, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ)

আরও পড়ুন