যেসব আত্মীয় একসময় অপমান করেছিলেন, এখন মুখে হাসি নিয়ে কথা বলেন
জীবনের কিছু পথ এতটাই কঠিন হয় যে সেখানে স্বপ্ন দেখাটাই দুঃসাহস। আমার পথটাও ঠিক তেমন ছিল। কখনো অভাব, কখনো অপমান, কখনো বৈষম্য—সব মিলিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল যেন একেকটি যুদ্ধ। তবু থামিনি। কারণ, বিশ্বাস করি, স্বপ্ন দেখার অধিকার কারও দান নয়, আর নিজের পরিশ্রমই তাকে সত্যি করে তোলে।
অভাব আর অপমানের দায়
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। এখানে প্রতিটি হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে কষ্ট, আর প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে লুকিয়ে থাকে সংগ্রাম। আমাদের সমাজে এখনো অনেকেই ভাবেন, মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া মানেই সীমাবদ্ধতা। কিন্তু আমি শিখেছি, সীমাবদ্ধতা নয়, বিশ্বাসই মানুষকে এগিয়ে নেয়।
বাবা ছিলেন পরিশ্রমী ও সৎ, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সব ঠিকঠাকই চলছিল, হঠাৎ প্রতিষ্ঠানটি সংকটে পড়ে; বাবার বেতন বন্ধ হয়ে যায়। টানা ১৬ মাস আয়রোজগার ছিল না। একসময় সংসারে এমন অবস্থা হলো যে অনেক দিন এক বেলাও ঠিকমতো খাওয়া হয়নি।
অভাবের সঙ্গে লড়াই করার চেয়েও কঠিন ছিল সমাজিক আচরণ। আত্মীয়রা সাহায্য তো করেনি, বরং অপমান করেছে। এক আত্মীয়র বাসায় সোনা চুরি হলে বলা হলো, আমরা গরিব, তাই আমরাই চুরি করেছি।
তখন আমার মা কেঁদেছিলেন, বাবা চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। আমিও অনেক কেঁদেছি। তখন বুঝেছি, গরিব হওয়া শুধু অর্থের অভাব নয়, সমাজের চোখে ছোট হয়ে থাকারও নাম।
থেমে যাওয়া স্বপ্ন
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোনোভাবে পড়াশোনা চলেছে আমার। তারপর অভাব, চাপ, উপহাস—সব মিলিয়ে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। মনে হয়েছিল, স্বপ্ন দেখাই বুঝি ভুল ছিল।
কিন্তু একদিন জীবনে এমন একজন এলেন, যিনি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘তুমি আবার পড়বে, আমি তোমার সব দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।’ তিনি শুধু আমার পড়াশোনার দায়িত্বই নেননি, বরং আমার জীবনের নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ, এমনকি বিয়ের দায়িত্ব পর্যন্ত নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া আজ যেখানে আছি, সেখানে কখনো পৌঁছাতে পারতাম না।
আবার পড়াশোনা শুরু করি। প্রথমে খুব কষ্ট হচ্ছিল। কারণ, অনেক দিন বাদে আবার বই হাতে নিয়েছি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। জানতাম, যদি এবার থেমে যাই, তাহলে আর কোনো সুযোগ আসবে না। সেই মানুষটির ভালোবাসা আর আমার মা–বাবার দোয়া আমাকে শক্তি দিয়েছে।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে একার লড়াই
বাংলাদেশের একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক করেছি। এই পথও সহজ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়াটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কেউ আমার পোশাক নিয়ে হাসত, কেউ উচ্চারণ নিয়ে, কেউ বলত, ‘গ্রাম থেকে এসেছে, কোটায় ভর্তি হয়েছে।’
জানতাম না, কোটায় আসা কোনো গর্বের ব্যাপার নয়, এটা অপমান। অফিসে কাজ করতে গিয়েও একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনেকে গুরুত্ব দিতে চাইত না, কেউ কেউ উপেক্ষা করত। কিন্তু মন শক্ত করে এগিয়ে গেছি। জানতাম, কাজই আমার জবাব।
জীবনের প্রতিটি ধাপে বুঝেছি, মানুষের মনোভাব বদলানো যায় না, কিন্তু নিজের মনোবল গড়ে তোলা যায়। যখন কেউ বলেছে, ‘তুই পারবি না’, তখন মনে মনে নিজেকে বলেছি, ‘আমি পারবই।’
জানি, এই সমাজে এখনো বৈষম্য আছে। কেউ মেয়ে বলে, কেউ গরিব বলে, কেউ গ্রাম থেকে এসেছে বলে তাকে ছোট করে দেখা হয়। কিন্তু বিশ্বাস করি, যে নিজের সীমাবদ্ধতাকে অজুহাত না বানিয়ে চেষ্টা করে যায়, তাকে কেউ থামাতে পারে না। লড়াইটা তাকে একা চালিয়ে যেতে হয়।
নিরাপত্তা, সাহস ও পথচলার শক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আর্থিক অনিশ্চয়তা ছিল বড় ভয়। কীভাবে এত বছর টানা খরচ চালাব, কীভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের বোঝা টানব—এসব নিয়ে চিন্তায় থাকতাম। ঠিক তখনই প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ বৃত্তি আমার জীবনে আলো হয়ে আসে। এটি শুধু সহায়তা নয়, আমাকে দিয়ে আত্মবিশ্বাস। জানতাম, কেউ আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছে। সেই বিশ্বাসই আমাকে এগিয়ে দিয়েছে প্রতিটি সেমিস্টার, প্রতিটি পরীক্ষা, প্রতিটি কঠিন সময়ে।
আমি যে সাহস নিয়ে পড়াশোনা করেছি, নিশ্চিন্ত মনে ক্লাসে গিয়েছি, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি, তার পেছনে প্রথম আলোর সহায়তার অনেক বড় অবদান আছে। এই সহায়তা না পেলে হয়তো আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন এতটা সুগম হতো না।
আজও স্বপ্ন দেখি, একদিন এমন জায়গায় পৌঁছাব, যেখান থেকে অন্য মেয়েদের বলতে পারব, ‘তুমি যত নিচ থেকে শুরু করো না কেন, তোমার সাহস থাকলে সম্ভাবনার সব দরজা খুলে যাবে।’
যাদের পরিবার দরিদ্র, যারা আত্মীয়স্বজনের অবহেলায় ক্লান্ত, যারা অপবাদ শুনে শুনে ক্লান্ত, তাদের ভয় পাওয়া চলবে না, দমে যাওয়া চলবে না। জীবন একটাই, আর সেই জীবন তুমি নিজেই গড়তে পারো। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে প্রথমে নিজের ভেতরে শক্তি আনতে হবে। অন্যের চোখে নিজের মূল্য খুঁজো না, নিজের চোখেই নিজের মূল্য ঠিক করো। সব সময় মনে রাখবে, তুমি যা, সেটাই তোমার গর্ব; যা নও, সেটা নয়।
নিজের পায়ে দাঁড়ানোই বৈষম্যের জবাব
আজ আমি ব্যাংকে চাকরি করি। নিজের খরচ নিজে চালাই, মা–বাবাকে কিছুটা সহায়তা করি। সেই আত্মীয়রা, যাঁরা একসময় অপমান করেছিলেন, এখন মুখে হাসি নিয়ে কথা বলেন। তাঁদের কথায় এখন আর ব্যথা লাগে না। কারণ, জানি, আমি নিজেই আমার জীবনের উদাহরণ। আমার এখনো অনেক স্বপ্নপূরণ বাকি।
আমি বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে চাই, নিজের জ্ঞানের পরিসর আরও বিস্তৃত করতে চাই। বিশ্বাস করি, সেখান থেকে ফিরে এসে সমাজের জন্য আরও বড় কিছু করতে পারব। কেউ যেমন একসময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, আমিও একদিন অসহায় কারও স্বপ্নপূরণে পাশে দাঁড়াতে চাই। জানি, পথ সহজ হবে না। কিন্তু আর থামব না।
স্বপ্ন থাকলে পথ তৈরি হয়
ব্যাংকে চাকরি করার পাশাপাশি নিজের একটি ছোট উদ্যোগও শুরু করেছি। ‘ওয়েস্টেরিয়া মার্ট’ নামের একটি ফেসবুক পেজ চালাই, মূলত পোশাক বিক্রি করি। অনেকেই বলে, চাকরি করলেই তো হলো, আবার ব্যবসা কেন? কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, একজন নারী শুধু চাকরি করে নয়, নিজের উদ্যোগের মাধ্যমেও স্বাধীন হতে পারে।
ওয়েস্টেরিয়া মার্ট শুধু একটি ফেসবুক পেজ নয়, এটি আমার সৃজনশীলতা, স্বপ্ন, আর আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। শুরুটা ছোট ছিল, কয়েকটা থ্রি-পিস দিয়ে। নিজের হাতে প্যাক করে, গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে, অর্ডার ডেলিভারি দিয়েছি। সেটি একটু একটু করে বড় হচ্ছে।
এখন অনেকে বলেন, ব্যাংকে চাকরি করার পরও তুমি এটা কীভাবে চালাও? আমার একটাই উত্তর, ইচ্ছা থাকলে সময় বের হয়, স্বপ্ন থাকলে পথ তৈরি হয়।
এই উদ্যোগ থেকে আমি শুধু অর্থ উপার্জন করি না, প্রতিদিন শিখি কাস্টমার সার্ভিস, মার্কেটিং, ট্রাস্ট বিল্ডিং আর সবচেয়ে বড় কথা, অর্জন করি আত্মবিশ্বাস।
আমি চাই, মেয়েরা শুধু চাকরি নয়, ব্যবসায়ও নিজেদের জায়গা করে নিক। সমাজের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নয়, তারা যেন নেতৃত্ব দেয় নিজের জীবনে, নিজের উদ্যোগে, নিজের স্বপ্নে।
আমার গল্প শেষ হয়নি। সামনে আরও অনেক পথ, আরও অনেক স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখতে টাকার দরকার হয় না; দরকার সাহস, বিশ্বাস আর অধ্যবসায়। প্রতিটি মেয়ে বিশ্বাস করুক, তার মধ্যেও শক্তি আছে, শুধু তা খুঁজে পেতে হবে।
ফারজানা আক্তার: ব্যাংকার ও ই–কমার্স উদ্যোক্তা