কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ যেখানে আলাদা

সৈয়দ শামসুল হকের সমাধি
ছবি: সংগৃহীত

বছর বছর নতুন ক্লাসের শুরুতে নতুন বইগুলো হাতে পেলেই উল্টে দেখা চাই। সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণটা একটু বেশি থাকায় সবার আগে বাংলা বইটায় চোখ বোলানো হতো। স্বভাবমতো ২০১৩ সালে নবম শ্রেণির বইগুলো হাতে পেয়ে ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে চোখ বোলাচ্ছিলাম। কী দারুণ সব গল্প-কবিতা। হঠাৎ একটা কবিতা দেখে থমকে যাই। ‘আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে, আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে’—এভাবে বাঙালির উঠে আসার উৎসভূমির কথা বলা হয়েছে। রচয়িতা? সৈয়দ শামসুল হক। শুধু আমি কেন, ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটির সূত্র ধরে আরও অনেকেরই নিশ্চয়ই এই সব্যসাচী লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আগ্রহ আরও বেড়ে গেল, যখন কবি পরিচিতিতে লক্ষ করলাম যে তাঁর জন্মভূমি আমার নিজ জেলা কুড়িগ্রাম।

আরও পড়ুন

তখন থেকেই সৈয়দ হককে জানার চেষ্টা। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ—কী লেখেননি তিনি! সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণের জন্যই তো উপাধি পেয়েছেন সব্যসাচী। একাদশ শ্রেণিতে এসে পাঠ্যবইয়ে আবারও তাঁর একটি তেজোদ্দীপ্ত কবিতা পড়ার সুযোগ হয়। কবিতার নাম ‘নূরলদীনের সারাজীবন’। ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’—এই একটি লাইনের মধ্যেই যেন বাংলার আপামর জনসাধারণকে সব অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অতএব সৈয়দ হকের প্রতি ভালো লাগাটা বাড়তে থাকে।

যখন উচ্চশিক্ষার জন্য কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হই, প্রথম দিন গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার সময় লক্ষ করি, বাঁ দিকে কলেজের মসজিদ, আর ডানে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন সৈয়দ শামসুল হক। আমাদের ক্যাম্পাস লাগোয়া তাঁর সমাধি।

প্রথম বর্ষে থাকাকালে সৈয়দ হকের জন্মবার্ষিকীর আয়োজনে একটি স্টল থেকে বাস্তবতার দাঁত ও করাত নামের উপন্যাসটি কিনেছিলাম। এর আগে তাঁর কিছু লেখা পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে পড়েছি। লাইব্রেরিতে দু-একটি বইও পড়েছিলাম। তবে তাঁর লেখা বই কেনা এটিই প্রথম। যথারীতি দুই দিনেই বইটি পড়ে শেষ করে ফেলি। কিছু বিষয় আধো স্পষ্ট থেকে যায়। বিশেষ করে ‘জলেশ্বরী’ আর ‘আধাকোষা’—শব্দ দুটো খুব চেনা মনে হলেও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কৌতূহলবশত সে সময় কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আবু যোবায়ের আল মুকুল স্যারের কাছে যাই। তাঁর কাছেই জানতে পারি, সব্যসাচী এই লেখক ভালোবেসেই নদ-নদীময় কুড়িগ্রামের নাম দিয়েছেন জলেশ্বরী। আর আধাকোষা, সে তো আমাদেরই ব্রহ্মপুত্র। জেনে ভীষণ ভালো লাগা কাজ করে।

আজও যখন কলেজ ক্যাম্পাসে যাই, প্রিয় লেখকের সমাধির পাশ দিয়ে যাই। মনে হয় এখানেই তো শুয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যের এক বরপুত্র, যিনি তাঁর অনবদ্য লেখনীতে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্য ভান্ডার। যিনি তাঁর বৈচিত্র্যময় সাহিত্যকর্মে কুড়িগ্রাম, রংপুর তথা গোটা উত্তরাঞ্চলকে পরম মমতায় পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন গোটা দেশের সাহিত্যপ্রেমী মানুষের সঙ্গে। ভাবতেই ভালো লাগে, এই সমাধি সারা দেশের অন্য কলেজ ক্যাম্পাসগুলো থেকে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজকে আলাদা করেছে।