বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন যেভাবে এতটা আস্থা অর্জন করল
ঢাকার মালিবাগ মোড়ের কাছেই হোসাফ টাওয়ার। সেই ভবনই বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের ঠিকানা। দেশের নানা প্রান্তের বহু থ্যালাসেমিয়া রোগীর কাছে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসাসেবা খাতে এই প্রতিষ্ঠানের গল্পটা একটু অন্য রকমই বটে।
সারি সারি বিছানায় অসুস্থ মানুষ। অধিকাংশই শিশু। রক্ত নিতে আসা এসব রোগীর সঙ্গে স্বজনেরাও উপস্থিত। এমনই এক মায়ের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনি কলেজের শিক্ষক। সন্তানকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য খুলনা থেকে ঢাকায় আসতে হয় তাঁকে। তাই এই প্রতিষ্ঠানেরই এক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক তাঁকে বলছিলেন, এখন খুলনায়ও আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি চালু হয়েছে। তিনি চাইলে সেখানেও সন্তানের চিকিৎসা করাতে পারেন। তবে সেই মায়ের বক্তব্য, যে সেবা এই প্রতিষ্ঠানে তিনি পাচ্ছেন, যতটা নিরাপদে তাঁর সন্তানকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে এখানে, তা অন্য কোথাও সম্ভব নয়। তাই কষ্ট হলেও সন্তানের সেরা চিকিৎসা নিশ্চিত করতে এখানেই আসবেন তিনি।
আস্থার মূলে কী
প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এই প্রতিষ্ঠানে আসেন আস্থা আছে বলেই। কীভাবে একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এতটা আস্থা অর্জন করল? উত্তরটা পাওয়া গেল সেই জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের কাছেই। তিনি অধ্যাপক ডা. সৈয়দা মাসুমা রহমান। প্রতিষ্ঠানটির সহসভাপতি। তিনি বলেন, ‘রক্তের মানের ব্যাপারে আপস করি না আমরা। রক্তদাতার দেহে থাকা জীবাণু সব সময় র্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব না–ও হতে পারে। তাই আমরা বিশেষায়িত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হই, রক্তদাতার দেহে এমন কোনো জীবাণু নেই, যা রক্তের মাধ্যমে গ্রহীতার দেহে প্রবেশ করতে পারে। এখানকার চিকিৎসক, নার্স ও সেবার দায়িত্বে থাকা প্রত্যেকেই যেন আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন, সেটিও নিশ্চিত করা হয়।’
শুরুর গল্পটা
কথা হলো প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব ডা. আব্দুর রহিমের সঙ্গে। শুরুটা ২০০২ সালে। তিনি তখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সেই সময়। পরিবারে থ্যালাসেমিয়া রোগী থাকায় তিনি এ রোগে আক্রান্ত রোগীর কষ্টটা জানতেন। ছাত্রাবস্থায় সন্ধানীতে কাজ করতে গিয়েও বহু থ্যালাসেমিয়া রোগীর কষ্ট অনুভব করেছেন।
সেই সময় থ্যালাসেমিয়া রোগীর প্রয়োজনীয় সব ওষুধও পাওয়া যেত না দেশে। একসময় ওষুধ আমদানির জন্য আমদানিকারক পর্যন্ত ছুটে গেছেন ডা. আব্দুর রহিম। তাঁর উৎসাহ দেখে জেন্ট্রি করপোরেশনের পরিচালক আবু তোরাব নিজ উদ্যোগে এক লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন ওষুধের জন্য। ওষুধ আমদানির প্রচেষ্টা সফল হওয়ার পর ধানমন্ডিতে একটি অফিসে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালু করেন। আরও বড় পরিসরে রোগীবান্ধব কার্যক্রম চালানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। নিবন্ধন নিয়ে ২০০৮ সালে ঢাকার শান্তিনগরে রোগীদের জন্য রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী সময়ে কাজের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়, বদলে যায় ঠিকানাও।
সেবার দুয়ার খোলা
ব্লাড ব্যাংক, ল্যাবরেটরি, ফার্মেসি—সবই আছে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের। প্রতিষ্ঠানটির ডোনার রিলেশনস অ্যান্ড পার্টনারশিপ ডেভেলপমেন্ট বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক মমতাজ জাহান জানালেন, একাধিক শিফটে রোজ ১০০ থেকে ১২০ রোগী রক্ত নেন এখানে। সরকারি ছুটির দিনে সংখ্যাটি দেড় শও ছুঁয়ে যায়। তবে ঢাকার বাইরে থেকে আসা বহু রোগীর ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা থাকে না। এমন রোগী ও স্বজনদের তিন দিনের বিনা মূল্যে থাকা–খাওয়ার জন্য দুটি আবাসেরও ব্যবস্থা রেখেছেন তাঁরা।
সামাজিক পরিসরে
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে প্রত্যেক সুস্থ মানুষেরই বিয়ের আগে পরীক্ষা করানো প্রয়োজন, তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না। দুজন বাহকের বিয়ে হলে তাঁদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ বিষয়েও সচেতনতামূলক কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। আরও আছে ওয়েলফেয়ার টিম। সেখানকার কর্মকর্তারা যাচাই করেন, আর্থিক সহায়তা কার সত্যিই দরকার।
জাকাত তহবিলের বিষয়টি দেখভালের জন্যও বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। বর্তমানে বিভিন্ন তহবিলের মাধ্যমে ২ হাজার ৮৬ জন অসহায় রোগীর চিকিৎসার সহায়তা দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ব্যক্তি উদ্যোগে কর্মীরাও রোগীদের পাশে দাঁড়ান। অসহায় মানুষের কষ্টের সাক্ষী কর্মীরা কখনো কখনো এমনটাও সিদ্ধান্ত নেন, পিকনিকের বরাদ্দ অর্থ রোগীর তহবিলে দিয়ে দেবেন তাঁরা। মানবতার এমন দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল।