সরকারি শিশু পরিবার থেকে প্রিমিয়ার লিগে খেলেছে মেয়েটা, স্বপ্ন দর্শকভরা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলার

সেই ছোটবেলায় আপনজন ছেড়ে তেজগাঁওয়ের সরকারি শিশু পরিবারে এসে উঠেছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌসী। ক্রিকেটে হাতেখড়িও এখানেই। ইন্দিরা রোড ক্রিকেট একাডেমির হয়ে এবার প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে খেলেছেন। দৃষ্টিও কেড়েছেন প্রশিক্ষকদের। এখন জাতীয় দলের হয়ে বল করার স্বপ্ন দেখেন। তাঁর আরও গল্প শোনাচ্ছেন নাজনীন আখতার

নেটে প্র্যাকটিস করছেন জান্নাতুল ফেরদৌসী
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

২০১২ সালের ১৭ মার্চ। জাতীয় শিশু দিবসে তেজগাঁও সরকারি শিশু পরিবারে গঠিত হলো ক্রিকেট দল। নাম ‘সরকারি শিশু পরিবার বালিকা, তেজগাঁও, ঢাকা’। দল গঠনের কাজটি করেন শিশু পরিবারটির উপতত্ত্বাবধায়ক ঝর্ণা জাহিন। দলভুক্ত হয় ২২ শিশু। যার মধ্যে জান্নাতুল ফেরদৌসও ছিলেন। তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শুরু হয় টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলা। বছরখানেক পর তাঁদের হাতে ওঠে কাঠের বল। সেই ২২ জনের মধ্যে বিভিন্ন সময় অনেকে ঝরে পড়ে। যারা টিকে আছে, তাদের মধ্যে একমাত্র জান্নাতুলই প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।

জান্নাতুলের বয়স ১৬ বছর। এক বছরের বিরতিতে এবার ছোট বোনের সঙ্গে এসএসসি পাস করেছেন। বিরতি কেন? জান্নাতুল জানালেন, গত বছর এসএসসি দেওয়ার পর বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) প্রশিক্ষণ চলার কারণে ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।

জান্নাতুলের প্রশিক্ষকেরাও তাঁকে নিয়ে সুদিনের স্বপ্ন দেখছেন। যেমন প্রথম প্রশিক্ষক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘বছর দুয়েকের মধ্যে জাতীয় দলে সুযোগ পাবে জান্নাতুল, এ ব্যাপারে আমি খুব আশাবাদী।’

আরও পড়ুন
জাতীয় দলের হয়ে বল করার স্বপ্ন জান্নাতুল ফেরদৌসীর
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

জান্নাতুল বর্তমানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন শেখ রাসেল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট ক্রিকেট একাডেমির প্রশিক্ষক সাইফুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, ‘জান্নাতুলকে নিয়ে আমার বড় পরিকল্পনা রয়েছে। জান্নাতুল ডানহাতি পেস বোলার। এ বছর তাকে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে অন্তর্ভুক্ত করানোর জন্য প্রস্তুত করছি।’

খেলার সময় জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের ডানহাতি পেস বোলার মারুফা আক্তারকে অনুসরণ করেন জান্নাতুল। তবে হতে চান বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলমের মতো। জাতীয় দলের ক্রিকেটার মোস্তাফিজুর রহমান আর ভারতীয় ক্রিকেটার ভুবনেশ্বর কুমার জান্নাতুলের প্রিয় ক্রিকেটার।

শৈশব থেকে এ পর্যন্ত জান্নাতুলের চলার পথ মসৃণ ছিল না। মা-বাবার বিচ্ছেদের পর শিশু পরিবারই হয় তাঁর ঠিকানা। তাঁর ছোট বোনও এখানকার বাসিন্দা। তেজগাঁও সরকারি শিশু পরিবারের (বালিকা) উপতত্ত্বাবধায়ক ঝর্ণা জাহিন বলেন, বর্তমানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিশু পরিবারে ভর্তি করা হলেও একসময় বাবা রয়েছে, এমন শিশুদের নেওয়া হতো না। জান্নাতুল ও তার বোনকে নেওয়ার কারণ ওদের মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। দুই সন্তানকে নিয়ে বোনের বাসায় গিয়ে উঠেছিলেন তাঁদের মা। অন্যের বাড়িতে কাজ করে দুই সন্তানকে লালন-পালন করতেন। আর্থিক অনটনের মধ্যে তিনি জান্নাতুলকে নিয়ে আসেন তেজগাঁওয়ে সরকারি শিশু পরিবারে।

জান্নাতুল বলেন, তাঁদের দুই বোনকে শিশু পরিবারে দেওয়ার পর মা আর অন্যের বাড়িতে কাজ করেননি। মাকে এখন খালাতো ভাই দেখেন। ছোট ছিলেন, সংসারের অবস্থা কম বুঝতেন। বড় হওয়ার পর মায়ের ওই সময়ের কষ্টটা অনুভব করতে পারেন। তবে দিনমজুর বাবার প্রতিও এখন আর কোনো বিদ্বেষ বোধ করেন না। শিশু পরিবারে দুই বোন ভর্তি হওয়ার বছর তিনেক পর বাবা কীভাবে কীভাবে যেন খোঁজ পান। তিনি দুই মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। মেয়েদের দেখে আপ্লুত হয়ে কান্নাকাটি করেন। মাকে ঘিরেই তাঁদের পরিবার, তবে মাঝেমধ্যে বাবা এসে দেখা করে যান।

জান্নাতুল স্পষ্ট করে বললেন, মা-বাবার বিচ্ছেদ, বাবার পেশা, একসময় অন্যের বাড়িতে মায়ের কাজ করা, সংসারের আর্থিক পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে কখনো হীনম্মন্যতায় ভোগেন না। দেশ-বিদেশের ইতিহাস সৃষ্টি করা অনেক খেলোয়াড় চরম দারিদ্র্যে বাস করে প্রতিকূলতা ঠেলে বড় হয়েছেন। জান্নাতুলও এগোতে চান। ভালো ক্রিকেটার হতে চান। তাঁর স্বপ্ন, একদিন দর্শকভর্তি বড় স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলবেন। সেই দিন দর্শকসারিতে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকবেন তাঁর ‘আম্মা’।