শাবিপ্রবির এই ল্যাবে কাজ করা শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন শিক্ষক ও গবেষক
গবেষণাগারটির আয়তন মোটে ২০০ বর্গফুট। তবে তরুণ গবেষকদের দাবি, তড়িৎ রসায়নবিষয়ক গবেষণার জন্য এটি দেশের অন্যতম সেরা। কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আছে, আছেন একদল একনিষ্ঠ গবেষক। ২৪ ঘণ্টাই এখানে কাজ চলে। সরকারি কোনো অর্থায়ন নেই, তবু গত ১৫ বছরে এই গবেষণাগার নিজস্ব একটা অবস্থান দাঁড় করিয়ে ফেলেছে।
বলছি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ‘তড়িৎ রসায়ন ও ক্যাটালিসিস গবেষণাগার’ (ইসিআরএল)–এর কথা। ২০১০ সালে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাতের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণাগারটি গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে যন্ত্রপাতির অভাব ছিল। বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প থেকে পাওয়া অর্থে ধীরে ধীরে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেন তিনি। এই গবেষণাগারে কাজ করা শিক্ষার্থীদের ১২৫টি গবেষণা নিবন্ধ প্রথম সারির আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এই ল্যাবে কাজ করা ৩৬ শিক্ষার্থী বর্তমানে দেশ–বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। অনেকে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানী বা গবেষক হিসেবেও নিয়োজিত। প্রত্যেকেই শাবিপ্রবির রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। অধ্যাপক আবুল হাসনাতের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে গবেষণায় যুক্ত আছেন একই বিভাগের ১২ শিক্ষার্থী।
অধ্যাপক আবুল হাসনাত বলেন, ‘আগ্রহী শিক্ষার্থীরাই এখানে কাজ করার সুযোগ পায়। তারা দিনরাত এক করে গবেষণা করে। মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগেই স্কোপাস ইনডেক্সযুক্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রত্যেকের অন্তত পাঁচটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। ফলে পেশাগত জীবনে প্রবেশের আগেই নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ পায় তারা। পাশাপাশি দলগত কাজের মাধ্যমে প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞানার্জনের পরিবেশ তৈরি হয়, যেটি আমার মূল লক্ষ্য। গবেষণামুখী জাতি গঠনের স্বপ্ন থেকেই এই গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা।’ শাবিপ্রবির এই শিক্ষক জানান, এখানে শূন্য–কার্বন নিঃসরণ প্রযুক্তি, ব্যাটারি ও ফুয়েল সেল, ভূগর্ভস্থ পানির গুণগতমান যাচাই, পানিতে আর্সেনিক শনাক্তকরণ, রাসায়নিক সেন্সর তৈরিসহ নানা বিষয়ে গবেষণা হয়।
এই ল্যাব থেকেই গবেষণায় হাতেখড়ি হয়েছিল জান্নাতুল মুমতারিনের। জাপানের কুমামোতো ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে কর্মরত এই সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘২০১৩ সালে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় তড়িৎ রসায়নের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। সেখান থেকে অধ্যাপক আবুল হাসনাত স্যারের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু। কত নির্ঘুম রাত যে ল্যাবে কেটেছে, হিসাব নেই। কয়েকটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ হয়েছে। তখন বুঝিনি, সেই গবেষণার ধারাবাহিকতায় একদিন আমি বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব।’
বুয়েটের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন শাবিপ্রবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী মুনিরা সিদ্দীকা। তিনি বলেন, ‘আমাদের ইসিআরএল ল্যাব জ্ঞান অন্বেষণ ও নতুন কিছু আবিষ্কারের দারুণ জায়গা। এখানে ইলেকট্রোকেমিস্ট্রির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। ব্যাটারি, ফুয়েল সেল বা সেন্সর প্রযুক্তির উন্নয়নে এর প্রয়োগ অপরিহার্য। শুধু গবেষণার নতুন দিগন্তই উন্মোচন করছে না, শিল্প ক্ষেত্রেও উদ্ভাবনী সমাধান আনছে। আমাদের ল্যাব নিয়মিত বিভিন্ন জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করে, যা আমাদের কাজের মান ও প্রসারের প্রমাণ।’
একই কথা বলেন শাবিপ্রবিতে সদ্য নিয়োগ পাওয়া আরেক প্রভাষক ইমরান হোসেন। তাঁর বক্তব্য, ‘বিশ্বের নামী গবেষকদের সঙ্গে পরিচিতি ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলারও সুযোগ করে দিচ্ছে এই ল্যাব। জাপান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যৌথ গবেষণা করছি। এমনকি তাঁদের ল্যাবে সরাসরি কাজ করার অভিজ্ঞতা ও নতুন কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে, যা আমাদের গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।’
বর্তমানে ল্যাবে কাজ করছেন রসায়ন বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সুরভী রাণী সাহা। তিনি বলেন, ‘হাসনাত স্যার খুব আন্তরিকভাবে গবেষণার খুঁটিনাটি শেখান। আমরা যেন দলের সঙ্গে কাজ করার চর্চাটা ধরে রাখি, সেটা নিশ্চিত করতেও তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমাদের মধ্যে যেটুকু সম্ভাবনা আছে, আমরা তার সবটা কাজে লাগাতে চাই।’