জমিদারদের আলিশান সব হুঁকা আছে নাজমুলের সংগ্রহে
৫০ বছর ধরে নানা দুর্লভ জিনিস সংগ্রহ করে চলেছেন নাজমুল হক। এর মধ্যে হুঁকাই আছে প্রায় সাড়ে তিন শ। তাঁর হুঁকা সংগ্রহশালাটি দেখে এসেছেন নিজাম বিশ্বাস
‘হুক্কার খবর জানি না,’ লোকছড়ার বহুল প্রচলিত এ লাইন অন্যদের জন্য সত্য হলেও পাবনার নাজমুল হকের ক্ষেত্রে খাটে না। কারণ, হুঁকার খবর না জেনে তাঁর উপায় নেই। এ জিনিস সংগ্রহ করাই যে তাঁর শখ।
নাজমুল হকের সংগ্রহে আছে নানা নকশা ও আকারের প্রায় ৩৫০টি হুঁকা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে এগুলো সংগ্রহ করেছেন তিনি। হুঁকার এই সংগ্রহশালার নাম দিয়েছেন তিনি ‘হুঁকালয়’। আবহমান বাংলার কৃষকের হাতে শোভা পাওয়া নারকেলের মালা দিয়ে গড়া গড়গড়া (হুঁকার আরেকটি নাম) তো আছেই, পাশাপাশি ঘরময় ছড়িয়ে আছে জমিদারদের আলিশান সব হুঁকা। তবে এগুলোর কোনোটাতেই টান দেওয়া যাবে না। কারণ, নাজমুল সাহেব ধূমপান করেন না, ধূমপানে কাউকে উৎসাহিতও করেন না; এ জিনিস সংগ্রহ করা শুধুই তাঁর শখ।
সংগ্রাহকমহলে ‘মন্টু ভাই’ নামেই বেশি পরিচিত নাজমুল হক। হেন জিনিস নেই, যা তিনি সংগ্রহ করেন না! অন্যান্য সংগ্রাহকের মতো তাঁরও রয়েছে মুদ্রাদোষ (পড়ুন মুদ্রা সংগ্রহ)। পাশাপাশি ডাকটিকিট, পুরোনো নথি, দোয়াত-কলম, তালা-চাবি, তেলের কুপিসহ নানা ধরনের অ্যান্টিকস থরে থরে তাঁর ঘরে সাজানো রয়েছে। জন্মশহর পাবনায় একটি জাদুঘর গড়ে তোলার ইচ্ছা তাঁর আছে। তবে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এখন তিনি রাজধানীবাসী। ঢাকার একটি অ্যাপার্টমেন্টেই গড়ে তুলেছেন তাঁর অস্থায়ী জাদুঘর। নাজমুল হকের সংগ্রহের নেশা প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো আর হুঁকা সংগ্রহ করছেন আজ ২৫ বছর। তাঁর সংগ্রহের সবচেয়ে বড় হুঁকাটির উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। সবচেয়ে ভারীটার ওজন ১০ কেজি। এটি পিতলের তৈরি। সবচেয়ে পুরোনো হুঁকাটি মোগল আমলের। আছে ক্ষুদ্রাকৃতির হুঁকাও। আর শুধু হুঁকাই নয়, হুক্কার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি উপকরণই সংগ্রহ করেছেন নাজমুল হক।
যেভাবে হঁকা এল
হুঁকার ইতিহাস, ঐতিহ্য বর্ণনায়ও নাজমুল হকের জুড়ি নেই। তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল, ভারতবর্ষে হুঁকার মাধ্যমে ধূমপান শুরু হয় ষোলো শতকে। মোগলসম্রাট আকবরের দরবারে ইউরোপীয় দূতের আগমন এবং সম্রাটকে উপহার হিসেবে তামাক প্রদান ভারতীয় উপমহাদেশে হুঁকা প্রবর্তনে অনুঘটকের কাজ করে। ভারতীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে তামাক জনপ্রিয় হয়ে উঠলে এর ক্ষতিকারক দিক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন চিকিৎসক আবুল ফতেহ গিলানি। বলা হয়ে থাকে, তামাকের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে তিনিই পরে হুঁকা আবিষ্কার করেন। জলের মাধ্যমে ধোঁয়া পরিশোধন করার উপায় হিসেবে তিনি হুঁকা ডিজাইন করেছিলেন। মনে করা হতো, এভাবে শুদ্ধ করা হলে ধোঁয়া কম ক্ষতি করে।
হুঁকা উদ্ভাবিত হওয়ার পর মোগল অভিজাতদের মধ্যে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্রুতই সামাজিক মর্যাদা প্রকাশের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় হুঁকা। এ দেশে ব্যবসারত ইংরেজ ও অন্য ইউরোপীয়দের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে পড়ে। হুঁকাকে তারা বলত ‘হাবল-বাবল’। ধূমপানের সময় হুঁকা থেকে বুদ্বুদ করে ধোঁয়া নির্গত হতো বলে এ নাম।
একসময় ভারতবর্ষের মতো মধ্যপ্রাচ্যেও ছড়িয়ে পড়ে হুঁকা।
হুঁকা নিয়ে প্রদর্শনী
একসময় বাংলার ঘরে ঘরে দেখা যেত এই হুঁকা। বর্তমানে হুঁকা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন জাদুঘর, বিশেষ করে সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘরে কাচবন্দী করা আছে হুঁকার কয়েকটি নমুনা, তবে নাজমুল হকের সংগ্রহ যেকোনো জাদুঘরের সংগ্রহকে হার মানিয়ে দেয়। হুঁকা ছাড়া ইতিহাসের আরও অনেক আকর তিনি সংগ্রহ করে রেখেছেন পরম মমতায়। দেশের বিভিন্ন জাদুঘর এসব উপকরণ সংগ্রহ বা প্রদর্শনের জন্য প্রায়ই তাঁর শরণাপন্ন হয়ে থাকে।
তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে একাধিকবার তুলে ধরেছেন তাঁর দুর্লভ সংগ্রহ। ২০০৭ ও ২০১৩ সালে পাবনায় এককভাবে প্রদর্শন করেছেন তাঁর শৌখিন দ্রব্যাদি। আর মুদ্রা প্রদর্শনীতে তিনি এক নিয়মিত মুখ। এসবের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একাধিক পুরস্কার ও সনদপ্রাপ্তিও ঘটেছে। বাংলার ঐতিহ্য হুঁকা নিয়েও একক একটি প্রদর্শনী করার পরিকল্পনা তাঁর আছে।