কাঠবিড়ালি কিটো যেভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বন্ধু হলো
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভবনের সামনে একটি গাছ থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিল ‘কিটো’। একে তো চোখ ফোটেনি, গায়ে রোম নেই, তার ওপর জন্মের সাত থেকে আট দিনের মধ্যেই গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তার অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। ডাক পেয়ে ছুটে আসেন সোয়ান (সেভ ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড নেচার)–এর দুই সদস্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফরোজা আক্তার ও সায়েম মিয়া। তাঁরা ওর জন্য একটা ইনকিউবেটর তৈরি করে দেন। শুরুতে ড্রপার দিয়ে দুধ খাওয়াতে হতো, আর এখন বাদাম খেতেও শিখে গেছে কিটো। ওহ বলতে ভুলেই গিয়েছি, ‘কিটো’ একটা কাঠবিড়ালি। শিক্ষার্থীদের আদরেই বড় হয়েছে, এরপর ওকে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
কিটোর মতো এমন অনেক বন্য প্রাণী উদ্ধার ও পরিচর্যা করে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে সোয়ান। এমনকি যেসব প্রাণী সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে, সেসবও উদ্ধার ও পরিচর্যা করে অবমুক্ত করে এই সংগঠন। গত আট মাসে রাসেলস ভাইপার ও খৈয়া গোখরাসহ ৫৬টি সাপ, পাঁচটি গুইসাপ, ৩৭টি পাখি ও পাঁচটি কাঠবিড়ালি উদ্ধার করেছে সোয়ান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন হলেও ক্যাম্পাসের বাইরেও চলে সোয়ানের কার্যক্রম। মানুষ ও বন্য প্রাণীর মধ্যে সংঘাত দূর করার উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে ক্লাবটি প্রকৃতিবিষয়ক গবেষণা ও প্রকৃতি সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে কাজ করে যাচ্ছে। শব্দদূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে জনমত সৃষ্টিতে কাজ করছে। সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি ইমরুল কায়েস বলেন, ‘একটি প্রাণীকে উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত ধাপগুলো প্রাণীটির ওপর নির্ভর করে। অসুস্থ প্রাণীর ক্ষেত্রে উদ্ধারের পর চিকিৎসা, চিকিৎসা–পরবর্তী পর্যবেক্ষণ, প্রকৃতিতে অভ্যস্ত করা এবং সবশেষ উপযুক্ত পরিবেশে মুক্ত করা হয়। আবার মানুষের জন্য বিপজ্জনক প্রাণী, যেমন সাপকে লোকালয় থেকে দূরে উপযুক্ত পরিবেশে মুক্ত করা হয়। বড় প্রাণী বন্য প্রাণী অধিদপ্তরের রেসকিউ সেন্টারের কাছে হস্তান্তর করি।’
বন্য প্রাণী উদ্ধার ও পরিচর্যার প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার ক্লাবের সক্রিয় কর্মীরা নিজেরাই বহন করেন। সরকারি–বেসরকারি কোনো সংস্থার সহযোগিতা না পেলেও ক্লাবের উপদেষ্টাদের দেওয়া অনুদান তাঁদের চলার পথের পাথেয়। স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীদের কাজগুলো আরও পেশাদার করতে বন্য প্রাণী অধিদপ্তর থেকে ক্লাবের সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। ইমরুল কায়েস জানান, সংগঠনটিকে ভবিষ্যতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলতে চান এবং সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চান।
সোয়ানের তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আফরোজা বলেন, ‘মানুষ ও প্রাণী উভয়ই প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি প্রাণী পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা মানুষেরা অনেক সময় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রাণীদের ক্ষতি করি। তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলে দিই। একজন বন্য প্রাণী উদ্ধারকর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি যে প্রাণ বাঁচানো শুধু একটি কাজ নয়, একটি অনুভব। আমি এমন একটি পৃথিবী দেখতে চাই, যেখানে মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে সেতুবন্ধ থাকবে। ভয় নয়, সহানুভূতিই হবে সেই সেতুবন্ধের মূলমন্ত্র।’