প্ল্যাকার্ড হাতে বনজঙ্গলে ঘোরেন পূর্ণতা

প্রাণী–পাখি, পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় মানুষকে সচেতন করতে কাজ করছেন তাসফিয়া তাহসিন। এ জন্য ছবি তোলার পাশাপাশি প্ল্যাকার্ড হাতে তাঁকে দাঁড়াতে দেখা যায় সাগরের পারে, পাহাড়ের চূড়ায়, বনে–জঙ্গলে। কাছের মানুষের কাছে পূর্ণতা নামে পরিচিত এই তরুণীর আরও গল্প শোনাচ্ছেন শুভা জিনিয়া চৌধুরী

‘সুন্দরবন বাঁচাও, বাংলাদেশ বাঁচাও’ লেখা পোস্টার হাতে তাসফিয়া তাহসিন
ছবি: তাসফিয়া তাহসিনের সৌজন্যে

হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের একটি সড়কে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তাসফিয়া তাহসিন। প্ল্যাকার্ডে লাল কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘হর্ন বাজিয়ে প্রাণীদের বিরক্ত করবেন না’।

সুন্দরবন, কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়া দ্বীপেও পোস্টার হাতে একাই দাঁড়িয়েছেন। মানুষকে জানাতে চেয়েছেন, ‘সুন্দরবন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’, ‘বাংলার ফুসফুস সুন্দরবনকে রক্ষা করো’, ‘সোনাদিয়ার প্রাণিবৈচিত্র্য রক্ষা করো’।

পূর্ণতাকে প্ল্যাকার্ড হাতে দেখলে সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের কৈশোরের চেহারা মনের মধ্যে ভাসে। গ্রেটার মতো সদ্য কৈশোর পেরোনো পূর্ণতাও পরিবেশ বাঁচাতে চান, রক্ষা করতে চান পশুপাখির বিচরণক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির এই প্রস্তুতির মধ্যেও থেমে নেই পূর্ণতার চেষ্টা। এ জন্য ছুটে যান দেশের নানা প্রান্তে।

এই সচেতনতার বার্তা ছড়ানোর কাজে জড়িয়ে পড়ার পেছনেও আছে পূর্ণতার আলোকচিত্রপ্রীতির গল্প।

সোনাদিয়া দ্বীপে পূর্ণতার প্রচারণা
ছবি: তাসফিয়া তাহসিনের সৌজন্যে

পূর্ণতার স্বপ্ন

পূর্ণতা ক্যামেরা হাতে পেয়েছিলেন শৈশবে। কৈশোরে এসে পশুপাখির ছবি তোলায় উৎসাহী হলেন। সেই গল্পই বলছিলেন পূর্ণতা, ‘২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি মা–বাবার সঙ্গে কিশোরগঞ্জের নিকলীতে বেড়াতে গিয়েছি। ভরদুপুরে বাবার সঙ্গে দিগন্তবিস্তৃত মাঠে ঘুরছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে বাবার সঙ্গে পুকুর পারে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। সেখানেই হঠাৎ দেখা অচেনা কয়েকটি পাখির সঙ্গে। জামগাছের ডাল থেকে কয়েকটা পাখিকে একটু পরপর পুকুরে ডাইভ দিতে দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল মাছ শিকার করছে। পরে ভুল ভাঙে। পাখিগুলো আসলে স্নান করছিল। কাঁপাকাঁপা হাতে সেই প্রথম পাখির ছবি তুলি। পরে ইন্টারনেটে জানতে পারি, এগুলো সবুজ সুইচোরা পাখি, বাঁশপাতি নামেও এরা পরিচিত।’

সেই শুরু। এর পর থেকে পূর্ণতা জড়িয়ে পড়লেন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফিতে। ছবি তুলতে তুলতেই গণমাধ্যম থেকে পূর্ণতা জেনেছেন দেশে পাখি ও বন্য প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। তাঁর কৈশোর মনে তখন দোলা দিল, এমন ধারা চলতে থাকলে হয়তো অনেক পশুপাখি হারিয়ে যাবে। মানুষকে সচেতন করতে তাই পূর্ণতা ছবি তোলার পাশাপাশি প্রচারণাও শুরু করেন। শুরু হয় হাতে পোস্টার আর প্ল্যাকার্ড বানানো।

ছোটবেলা থেকেই ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি করেন তাসফিয়া
ছবি: তাসফিয়া তাহসিনের সৌজন্যে

২০২২ সালে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মা–বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে পূর্ণতা খেয়াল করেন, উদ্যানের মাঝের সড়কে গাড়ির অনুমোদিত গতিসীমা ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার। কিন্তু বেশির ভাগ চালক মানেন না। তাঁরা অনেক বেশি গতিতে গাড়ি চালান, অপ্রয়োজনে ঘন ঘন হর্ন বাজান। তাতে প্রায়ই এখানে যানবাহনের চাকায় চাপা পড়ে নানা ধরনের প্রাণী মরে যায়। সেখানে ‘গতিসীমা মেনে চলুন, প্রাণী হত্যা রোধ করুন’ প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন পূর্ণতা।

এরপর মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিল, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, চট্টগ্রামের হাজারিখিল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য, রাজশাহীর পদ্মার চর—যেখানেই ছবি তুলতে গেছেন, সেখানেই প্ল্যাকার্ড, পোস্টার হাতে মানুষকে সচেতন করেছেন।

মেয়ের এসব কাজে উৎসাহ দেন সাংবাদিক মা–বাবা। বাবা জিয়াউর রহমান ও মা কামরুন নাহার শরমিন নিজেদের অনলাইন প্রতিষ্ঠান ‘অর্থসূচকে’ সাংবাদিকতা করেন। এর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদিকতা করেছেন তাঁরা। মেয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান মা–বাবা। ছবি তোলেন একসঙ্গে। মা–বাবার সঙ্গে তাই পাখির মতোই ডানা মেলে উড়ে বেড়ান পূর্ণতা।

পূর্ণতা জানালেন, বন্য প্রাণীর ছবি তোলার পাশাপাশি পাখির ছবিও আঁকেন তিনি। নিজের তোলা ও আঁকা ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনী করতে চান। প্রদর্শনী থেকে পাওয়া অর্থ প্রান্তিক পরিবার, বিশেষ করে বন-পাহাড় ও হাওরের আশপাশের শিশু-কিশোর, নৃগোষ্ঠীর শিশু-কিশোরদের দিতে চান পূর্ণতা।

পূর্ণতা পূর্ণ করুন তাঁর স্বপ্ন। বাঁচুক বন, প্রকৃতি, পাখি আর প্রাণিকুল। বাংলার মাটি, বাংলার জল পূর্ণ হোক পূর্ণতার স্বপ্নে।

আরও পড়ুন