কাছের মানুষ পাশে থাকলে কঠিন যুদ্ধেও জেতা যায়, তার প্রমাণ বিসিএস ক্যাডার মালিহা

এই গল্পের ‘নায়ক’ মুলকে সাদ মালিহা বিয়ের এক যুগ পার করে ৪৪তম বিসিএসে লাইভস্টক ক্যাডার হয়েছেন। বিয়ে আর ক্যাডার হওয়ার মাঝের গল্পটা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার, কখনো হাল না ছাড়ার।

৪৪তম বিসিএসে লাইভস্টক ক্যাডার হয়েছেন মুলকে সাদ মালিহাছবি: মুলকে সাদ মালিহার সৌজন্যে

মালিহার মা আসমা বেগমের কথা না বললেই নয়। জন্ম মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার কলমা গ্রামে। ঢাকায় বড় হয়েছেন। বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।

১৯৯৩ সালে জগন্নাথ কলেজে (সে সময় কলেজ ছিল, ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হয়) ভর্তি হন। এর এক বছর পর তাঁর বিয়ে হয়ে যায়।

একঝটকায় ঢাকার শিক্ষার্থী থেকে ঝিনাইদহের হরিশংকরপুর ইউনিয়নের বাকড়ি গ্রামের গৃহবধূ হয়ে গেলেন। আসমা বেগমের খুব ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করার।

স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার পাট চুকে গেল। চাকরির স্বপ্নের সমাপ্তি। মালিহা তাঁর মাকে সারাটা জীবন কেবল অন্যের জন্য করে যেতে দেখেছেন। বিনিময়ে মা পেয়েছে কেবল উপেক্ষা আর অবহেলা।

নতুন জীবন নতুন সংগ্রাম

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ২০১৩ সালে বিয়ে হয়ে যায় মালিহার। বিয়েতে মালিহার মায়ের কেবল একটা অনুরোধ ছিল পাত্র মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর মা-বাবার কাছে—তাঁর কন্যার লেখাপড়ার যাতে কোনো ত্রুটি না হয়। বিয়ের পর মায়ের ইচ্ছায়, স্বামীর পরামর্শে মালিহা ভর্তি হন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেনারি কলেজে।

মালিহা এই কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। তখন কলেজটি ছিল শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। বর্তমানে কলেজটি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

২০১৯ সালের মার্চে ইন্টার্ন চলাকালীন মা হন মালিহা। মা হয়েও ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করেন। তারপর সময় নষ্ট না করে শুরু করেন চাকরির পড়াশোনা।

সারা জীবন কেবল চেয়েছি মায়ের কষ্টের ভাগ নিতে। কী করলে আমার মা একটু স্বস্তি পাবে। আমার স্বামী সব সময় আমার পাশে ছিলেন। আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বলেছেন, “তুমি কেবল আবেগ নিয়ে কখনোই মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারবা না। এ জন্য তোমার পায়ের নিচের মাটি শক্ত হতে হবে।” আমাকে আরও বলত, “আমার মতো স্টুডেন্টের যদি সরকারি চাকরি (ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার) হয়, তোমার কেন হবে না। তুমি আমার চেয়ে বেশি যোগ্য, বেশি পরিশ্রমী, তোমার আরও ভালো চাকরি হবে।”
মুলকে সাদ মালিহা, লাইভস্টক ক্যাডার, ৪৪তম বিসিএস

যে কান্না আনন্দের

মালিহার মামি শিক্ষা ক্যাডার হন। সে সময় থেকে তাঁর রঞ্জু মামা তাঁকে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন। মালিহা ২০২০ সাল থেকে চাকরির পড়াশোনা শুরু করেন। ২০২৫ সালে এসে প্রথম সরকারি চাকরি পান। যোগ দেন সরকারি ব্যাংকের অফিসার পদে।

এর কিছুদিন পর ৩০ জুন ৪৪তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করে। তবে তখন ক্যাডার পদ আসেনি মালিহার। বেশ হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন।

লাইভস্টক ক্যাডারে ৬৮জন ‘রিপিট ক্যাডার’ ছিল। সেসব পুনর্মূল্যায়ন করে আবার যখন ৬ নভেম্বর নতুন ফল প্রকাশ করা হয়, তাতে নাম আসে মালিহার। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নপূরণ হয় তাঁর।

মালিহার মা আসমার নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন যেন মেয়ের ভেতর দিয়ে সত্য হয়ে ধরা দেয়। মালিহা যখন চাকরির সুখবর জানাতে মাকে ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে ‘আম্মুউউউ’ বলে একটা চিৎকার দিয়েছেন, মা আসমা বেগম ভয়েই অস্থির! নিশ্চয়ই মেয়ের কোনো বিপদ হয়েছে। এরপরই শুনলেন খবরটা। মা-মেয়ে দুজনেই ফোনের দুই পাশে কাঁদছেন, যে কান্না আনন্দের, প্রাপ্তির, সফলতার।

মামির শাড়ি আর ব্লেজার পরে বিসিএসের ভাইভা দিয়েছেন মালিহা
ছবি: মুলকে সাদ মালিহার সৌজন্যে

যাঁদের জন্য এত দূর

মালিহা বলেন, ‘আমার আম্মু সব সময় বলত, আমি যদি বিসিএস ক্যাডার হতে পারি, তাহলে তাঁর সব কষ্ট সার্থক হবে। অনেক ঝড়ঝাপটা সামাল দিয়েছি, হতাশ হয়েছি, টেনশনে বুক ধড়ফড় করত, শ্বাস নিতে পারতাম না, ডাক্তার দেখিয়েছি, কিন্তু পড়াশোনা ছাড়িনি।’

মালিহার যে মামি বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার, ৪৪তম বিসিএসের ভাইভা দেওয়ার জন্য ওই মামির শাড়ি আর ব্লেজার নিয়ে গিয়েছিলেন। ৪৫তম বিসিএসের ভাইভা দিয়েছেন। ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষাও দিয়েছেন।

মা আসমা বেগম (ডানে) ও মেয়ে তাইয়্যেবার সঙ্গে মালিহা
ছবি: মুলকে সাদ মালিহার সৌজন্যে

মালিহা বলেন, ‘ভাইভা দিতে গিয়ে কোথায় থেকেছি, জানেন? ফেসবুকের মাধ্যমে আফরিন আপুর সঙ্গে পরিচয়। তাঁর বাসা ঢাকার পিএসসি অফিসের কাছে। তিনি আমাকে তাঁর বাসায় থেকে ভাইভা দিতে বলেছিলেন। আমিও ঝিনাইদহ থেকে সোজা তাঁর বাসায় উঠে ৪৪ আর ৪৫ বিসিএসের ভাইভা দিয়েছি।’

আরও পড়ুন

জীবনসঙ্গী যখন অনুপ্রেরণা

মালিহার বাবা তাঁর পড়াশোনায় বা অন্য কিছুতে সমর্থন না করলেও সব সময় সঙ্গে ছিলেন মা আর স্বামী। সন্তান নিতে দেরি হওয়া থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজন কথা শোনালে এই দুজনই ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

মালিহার পড়াশোনায় বা অন্য কিছুতে সব সময় পাশে পেয়েছেন স্বামী মোস্তাফিজুর রহমানকে
ছবি: মুলকে সাদ মালিহার সৌজন্যে

মালিহা বলেন, ‘পাঁচ বছরে আমরা কোথাও বেড়াতে যাইনি। যখনই সময় পেয়েছি, পড়তে বসেছি। বাবু হয়তো খেলছে, আমি পড়তে বসেছি। বাবু আর আমার স্বামী ঘুমিয়ে পড়তেন, আমি পড়তে বসতাম। আবার রাত দুইটায় আমার স্বামী উঠে কফির মগ হাতে আমি যা যা পড়েছি, সেসব পড়া ধরতেন। পরের দিন, পরের সপ্তাহে কী কী পড়ব, তার রুটিন করে ঘুমাতে যেতাম। আমার স্বামী আমাকে বলতেন, “তুমি হয়তো অন্যদের মতো ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা পড়তে পারবা না; কিন্তু তুমি দৈনিক ৪-৫ ঘণ্টা পড়বা। এক পাতা হলেও পড়বা।” আমি সে কথা রেখেছি। গত ৫ বছরে এক দিনও পড়িনি, এমন কখনো হয়নি। এক পাতা হলেও পড়েছি।’

জীবনের নতুন আরেক অধ্যায় খুলেছেন মালিহা। তাঁর স্বপ্ন এখন আরও বড়। অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে চান বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা নারীদের কাছে। কামনা করেন, কোনো নারীই যেন হাল না ছাড়েন।

আরও পড়ুন