যে হেলমেটে আপনার মাথা থাকবে নিরাপদ

মামলার ভয়ে অনেকে নিম্নমানের অথবা টুপি সদৃশ হেলমেট পরে থাকেন। এতে মামলা থেকে বাঁচলেও অসতর্কতাবশত দুর্ঘটনায় পড়লে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ফ্র্যাকচারসহ বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে

মানসম্পন্ন হেলমেট চালক বা আরোহীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেমডেল: আফসানা, কৃতজ্ঞতা: এক্সো মটো, ছবি: কবির হোসেন

হেলমেটের কোনো বিকল্প নেই। মোটরসাইকেল চালানোর সময় মাথা নিরাপদ রাখতে হেলমেট পরতেই হবে। বাংলাদেশের সড়ক আইন অনুযায়ীও মোটরসাইকেলচালক ও আরোহীর হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। তবে মানহীন হেলমেট চালক বা আরোহীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না।

হেলমেট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তরুণ চালকেরা নিরাপত্তার পাশাপাশি খোঁজেন স্মার্ট নকশা এবং ওজনে হালকা হেলমেট। যেমন মৌরির হেলমেটটির কথা ধরা যাক। একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন তিনি। গোলাপি শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর হেলমেটটিও গোলাপি। গ্রাফিকসের কাজও করা হয়েছে। ঝুঁটি বেঁধে ছেড়ে দেওয়া চুলকে স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য হেলমেটের পেছনে রয়েছে খাঁজকাটা নকশা। নিজের স্কুটি চালিয়ে এভাবেই নিজ কার্যালয়ে পৌঁছান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইকরাম খান যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করেন ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের ফেজার মোটর বাইক। লাল রঙের বাইকটির সঙ্গে মিলিয়ে রেসিং গ্রাফিকসের হেলমেট ব্যবহার করেন তিনি। স্টাইলের সঙ্গে পেয়ে যান নিরাপত্তা।

হেলমেটগুলো মাঝারি, বড় এবং অতিরিক্ত বড় আকারে পাওয়া যায়
ছবি: কবির হোসেন

হেলমেটের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক জসিম উদ্দিন (ফেজ-বি রেসিডেন্ট, কার্ডিওলজি) জানালেন, মামলার ভয়ে অনেকে নিম্নমানের অথবা টুপি সদৃশ হেলমেট পরে থাকেন। এতে মামলা থেকে বাঁচলেও অসতর্কতাবশত দুর্ঘটনায় পড়লে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ফ্র্যাকচারসহ বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

হেলমেট কেনার ক্ষেত্রে তাই সৌন্দর্যের পাশাপাশি মান যাচাই করে নেওয়াটাও জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রে ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্ট বা ডটের সনদ আছে, এমন হেলমেট ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে ইউরোপে জাতিসংঘ স্বীকৃত ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ বা ইসিই সনদের হেলমেট ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়। এই দুই সনদের যেকোনো একটা পাওয়া হেলমেট নিরাপত্তা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের দিক থেকে এগিয়ে।

আরও পড়ুন

মূলত চারটি উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় একটি হেলমেট। হেলমেটে ব্যবহার করা হয় কর্কশিট; প্যাডিং; তাপ, চাপ, প্রভাব-শোষণকারী বিশেষ কাপড় এবং ধুলাবালু, বাতাস বা বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা পেতে স্বচ্ছ কাচ বা ঢাকনা। চালক বা আরোহীর মাথা ও মুখমণ্ডলকে রক্ষা করতে এ সব উপাদান একসঙ্গে কাজ করে। সাধারণ হেলমেটগুলোতে প্লাস্টিকের প্রাধান্য বেশি থাকে। গঠন অনুসারে হেলমেটকে ৬টি ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে পুরো মুখ ঢেকে যায়, এমন চার রকমের হেলমেটের দেখা মেলে—ফুল ফেস, মডিউলার, অফ-রোড, ডুয়েল স্পোর্ট, ওপেন ফেস, হাফ হেলমেট। ফুল ফেস হেলমেটে চোয়াল ও থুতনি ঢেকে থাকে। এ জন্য এসব হেলমেটে আলাদা ব্লকেজ দেওয়া হয়। এসব হেলমেটে চোয়ালের অংশটি স্থির থাকে। আর মডিউলারে চোয়ালের অংশকে লিভারের সাহায্যে মাথার ওপরে তুলে রাখা যায়, অর্থাৎ এ ধরনের হেলমেট কেউ চাইলে মুখ খোলা রেখেও পরতে পারবেন, আবার চোয়াল ঢেকেও পরতে পারবেন। মহাসড়ক এবং শহরের রাস্তায় চালানোর জন্য মডিউলার হেলমেট বেশ জনপ্রিয়। এ ধরনের হেলমেটে ফেসগার্ডকে নিরাপত্তাবলয়, ভাইজরসহ (চোখ সুরক্ষার জন্য বিশেষ গ্লাস) মাথার ওপর তুলে রাখা যায়। আবার প্রয়োজনে ফুল ফেস হেলমেট হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। অফ-রোড হেলমেটগুলো কাদামাটি, পাহাড়, সমুদ্রের পাড়ে চালানোর জন্য শক্তিশালী করে বানানো হয়। ডুয়েল স্পোর্টকে বেছে নেওয়া হয় উচ্চগতিতে বাইক চালানোর সময় বা রেসিঙের সময়। এ ছাড়া শুধু মাথাকে ঢেকে রাখবে কিন্তু মুখমণ্ডল খোলা থাকবে, এমন হেলমেটও পাওয়া যায়। এগুলোকে বলে যথাক্রমে হাফ ও ওপেন ফেস হেলমেট।

বাজারে আছে নানা নকশার আর রঙের হেলমেট
ছবি: কবির হোসেন

মাথায় অতিরিক্ত একটি সরঞ্জাম রাখতে হয় বলে অনেক চালক বা আরোহী হেলমেট পরতে অনীহা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে হেলমেট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এক্সো মটোর স্বত্বাধিকারী আল মামুন বলেন, উন্নত মানের হেলমেটগুলোর ওজন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।

আবার গরম লাগে বা মাথায় বাতাস প্রবেশ করে না বলেও অনেকে হেলমেট এড়িয়ে চলেন। তবে এনজেডআইয়ের ফিউশন সামার এডিশন নামের একটি মডেল রয়েছে। এই মডেলের হেলমেটে আটটি ভেন্টিলেটর থাকার কারণে পর্যাপ্ত বাতাস প্রবেশ করতে পারে। হেলমেটগুলো মাঝারি, বড় এবং অতিরিক্ত বড় আকারে পাওয়া যায়। মডেলটির মূল্য ছয় হাজার টাকা বলে উল্লেখ করেন এক্সো মটোর বিপণন এবং বিক্রয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ।

হেলমেট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তরুণ চালকেরা নিরাপত্তার পাশাপাশি খোঁজেন স্মার্ট নকশা এবং ওজনে হালকা হেলমেট
ছবি: কবির হোসেন

রাজধানীর বংশাল, বাংলামোটর, মিরপুর ১০, ষাট ফিট, উত্তরাসহ বিভিন্ন মোটর বাইকের পার্টসের মার্কেটে হেলমেট পাওয়া যায়। দাম ও মান অনুসারে সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকার হেলমেটও পাওয়া যায়। দেশের বাজারে হেলমেট উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে পুরোটাই আমদানিনির্ভর। ফ্রান্স, ইউরোপ, চীন ও ভারত থেকে আমদানিকারকেরা প্রায় ২০টি ব্র্যান্ডের হেলমেট দেশে বাজারজাত করে। টর্ক, স্টিলবার্ড, ভেগা, এইচজেসি, সিএসবি, এমটি, শার্ক, ইয়োহি, এক্সোর, এক্সিস, এইরোহ, এসএমকে, স্টুডস, এলএসটু, অ্যারোস্টারসহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের হেলমেট দেশের বাজারে পাওয়া যায়।

অনেক হেলমেটে অতিরিক্ত রোদচশমা মেলে। ভেতরের প্যাড খুলে ধোয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। হেলমেট কেনার ক্ষেত্রে মাথায় যেন অতিরিক্ত আঁটসাঁট অথবা খুব ঢিলা না হয়, সে বিষয়টি লক্ষ রাখতে হবে। নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করে নিজের চেহারার সঙ্গে মানানসই হেলমেট চালকের স্টাইলের বহিঃপ্রকাশও ঘটাবে। হেলমেট পরিষ্কারের ক্ষেত্রে নিয়মিত ভাইজরটি পরিষ্কার করতে হবে। পাশাপাশি রোদে দেওয়ার সুযোগ থাকলে সপ্তাহে একবার রোদে দেওয়া অথবা মাসে একবার ধুয়ে নিতে পারলে ব্যাকটেরিয়া, খুশকি বা জীবাণু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। নিরাপদ চলাচলে হেলমেট হোক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।

আরও পড়ুন