শিশুর হাতে কেন মাতৃভাষায় লেখা বই তুলে দেবেন

শৈশবে শেখার জন্য মাতৃভাষায় লেখা বই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণছবি: কবির হোসেন

মায়ের ভাষা শুনতে শুনতেই বড় হয় শিশু। প্রথম বুলিও সাধারণত সেই ভাষাতেই ফোটে। বেড়ে ওঠার দিনগুলোতেই মায়ের ভাষা তার বড় আপন মনে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হওয়ারও আগে জীবনের প্রথম পাঠ এই ভাষাতেই হয়। এ তো প্রতিটি শিশুর বেড়ে ওঠার সাদাসিধে গল্প। তবে পৃথিবীর সব শিশু কিন্তু মাতৃভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায় না। অথচ ইউনিসেফ বলছে, শৈশবে শেখার জন্য মাতৃভাষায় লেখা বই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মাতৃভাষা, অর্থাৎ নিজের শোনা প্রথম ভাষাটাই শিশুর জন্য সহজ। মনোবিজ্ঞানের মতে, এই ভাষার সঙ্গেই সে নিজের যোগ খুঁজে পায়। এই ভাষার মাধ্যমে পাওয়া তথ্য সহজে বুঝতে পারে শিশু। অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারে লেখকের ভাষ্য। স্বাভাবিকভাবেই বই থেকে সে অনেক সহজে জ্ঞান আহরণ করতে পারে। পরিচিত ভাষায় লেখা বইগুলো তার জন্য পড়া সহজ বলে তার বইপড়ার আগ্রহও বাড়ে। এমনটাই জানালেন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী শারমিণ হক।

শিশুর বিকাশে

পরিচিত, সহজ ভাষায় শিশু যে বই পড়ে, সেটি তার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। লেখক যে আবেগের বিস্তার ঘটান বইয়ের পাতায়, সেই আবেগের সঙ্গেও শিশু নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে। বইয়ে বর্ণনা করা কোনো চরিত্রকে কল্পনাও করতে পারে অনায়াসে। বই পড়ে কত সহজে জ্ঞানের আলোকিত প্রান্তরে প্রবেশ করা যায়, এ বিষয়টিও সে নিজের মতো করে বুঝে নিতে পারে। ফলে বইপড়ার প্রতি আগ্রহও বাড়ে। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মাতৃভাষায় লেখা বই শিশুকে দেওয়া হলে সে নানান বিষয়ে যেমন জানতে পারে, তেমনি এসব বইয়ের মাধ্যমে সৃজনশীলতার চর্চাও হয়। মাতৃভাষায় লেখা বইয়ে নিজের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়া পাবে শিশু। শিশুর মধ্যে দেশাত্মবোধ জন্মাবে। আবার অন্য ভাষার কিছু বইও যদি সে মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ পায়, তাহলে ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গেও সহজে পরিচিত হবে।

আরও পড়ুন
মাতৃভাষায় শেখার সুযোগ একটি শিশুর ভবিষ্যৎ একাডেমিক জীবনেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে
ছবি: প্রথম আলো

ভাষাগত দক্ষতা

মাতৃভাষায় লেখা বই পড়লে সেই ভাষায় শিশুর দক্ষতা বাড়ে। সুন্দরভাবে ভাষা শেখার দারুণ এক মাধ্যম হতে পারে বই। বই পড়তে পড়তে ভাষার খুঁটিনাটি নানান দিক সে আয়ত্ত করতে পারে। এমনকি নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে হলে একটি কথা কীভাবে বলা যেতে পারে কিংবা কীভাবে লেখা যেতে পারে, সেই ধারণাও স্পষ্ট হতে থাকে তার মনে। লেখার মান উন্নত হয়। লেখার কৌশলগত দিকগুলো বুঝতে থাকে ধীরে ধীরে।

একাডেমিক সাফল্য

মাতৃভাষায় শেখার সুযোগ একটি শিশুর ভবিষ্যৎ একাডেমিক জীবনেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাস্তবজীবনে মুখস্থবিদ্যার কার্যকারিতা নেই। তাই দীর্ঘস্থায়ী একাডেমিক সাফল্য পেতে হলে একাডেমিক বিষয়গুলোকে বুঝেই পড়তে হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস—সব বিষয়ের জন্যই ব্যাপারটা সত্য। শৈশব থেকেই যদি চেনাজানা ভাষার সহজবোধ্য বই পড়া হয়, তাহলে যেকোনো বিষয় বুঝে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলাটাও সহজ হয়।

আরও পড়ুন

পড়ায় আনন্দ

সুন্দর শৈশবের অন্যতম অনুষঙ্গ বই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বইপড়ার চর্চা অনেকটাই হারিয়ে গেছে প্রযুক্তির এই যুগে। মাতৃভাষায় সহজ, আকর্ষণীয় বইপড়ার সুযোগ পেলে শিশু বইপড়ার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাবে। মজার বইয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল ডিভাইসের মোহ এড়ানো যেতে পারে। এতে সে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকেও সুস্থ থাকবে। বড় হয়ে যাওয়ার পরও বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ের প্রতি তার আগ্রহ থাকবে। জীবনজুড়ে রয়ে যাবে সু-অভ্যাসের চর্চা।

ভিন্ন ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠাও সহজ হয়

মাতৃভাষায় বই পড়লে শিশু যে কেবল সেই ভাষাটিই শিখতে পারে, তা কিন্তু নয়। বরং এই অভ্যাস তার জন্য অন্যান্য ভাষা শেখারও বুনিয়াদ হয়ে ওঠে। নিজের ভাষায় দক্ষ একজন মানুষের পক্ষে অন্য ভাষা আয়ত্ত করা সহজ। মাতৃভাষায় লেখা বইপড়ার চর্চা থাকলে অন্য একটি ভাষা মোটামুটিভাবে শিখে ফেলার পর সে সেই ভাষার বইও উপভোগ করতে শুরু করবে। উচ্চশিক্ষা নিতে দেশের বাইরে যেতে হলে সেই সময় নতুন ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠার জন্যও শৈশবে মায়ের ভাষার বইপড়ার অভ্যাস তাঁর কাজে দেবে।

আরও পড়ুন