বিল গেটসের জীবন বদলে দেওয়া ৬ শিক্ষক

তিনি মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা। একসময় ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তবে এখন মানবকল্যাণমূলক কাজের জন্যই আলোচিত বিল গেটস। যে শিক্ষকেরা তাঁর জীবন গড়তে সাহায্য করেছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিল গেটস একটি নিবন্ধ লিখেছেন গেটসনোটস-এ। আজ শিক্ষক দিবসে প্রকাশিত হলো লেখাটির নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

বিল গেটস
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

আমার সৌভাগ্য, এমন মা-বাবার ঘরে জন্মেছি, যাঁরা আমার সাফল্যের জন্য সব করেছেন। এমন স্কুলে গিয়েছি, যেখানে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ ছিল। এসব সৌভাগ্যই আমার ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করেছে।

অবশ্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কিংবা হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন সেই শিক্ষকেরা; যাঁদের কাছ থেকে আমি শেখার সুযোগ পেয়েছি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত এমন শিক্ষকদের পেয়েছি, যাঁরা আমার ভেতরের সম্ভাবনাটা টের পেয়েছিলেন (যখন সেটা দুষ্টুমির আড়ালে চাপা ছিল)। তাঁরা আমাকে সত্যিকার দায়িত্ব দিয়েছেন। বক্তৃতা নয়—অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার পথ করে দিয়েছেন। আগ্রহগুলো আবিষ্কারের সুযোগ দিয়েছেন।

আজ বলব পাঁচ শিক্ষকের কথা। যাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে পৃথিবীকে দেখতে হয়, কী আমি অর্জন করতে পারি।

ব্লানশ ক্যাফিয়েরি

ব্লানশ ক্যাফিয়েরি আমার জীবনে দুবার এসেছিলেন—প্রথমে প্রথম শ্রেণির শিক্ষক হিসেবে। পরে চতুর্থ শ্রেণিতে আমার প্রথম ‘বস’ হিসেবে, যখন তিনি ভিউ রিজ এলিমেন্টারি স্কুলের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। আমি ছিলাম ক্লাসের (বাইরেও) ভীষণ দুষ্টু, অস্থির ছাত্র। সব সময় নিজের দুনিয়ায় ডুবে থাকতাম। বেশির ভাগ শিক্ষক আমাকে একটা ‘সমস্যা’ হিসেবে দেখতেন, যেটা সমাধান করা দরকার। কিন্তু মিসেস ক্যাফিয়েরি আমাকে দেখেছিলেন ‘সমস্যা সমাধানকারী’ হিসেবে। বাকিরা যখন বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে আমাকে চ্যালেঞ্জ দেবেন, আমার শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাবেন, তখন মিসেস ক্যাফিয়েরি আমাকে তাঁর লাইব্রেরি সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন।

আরও পড়ুন

তিনি যখন আমাকে লাইব্রেরির হারিয়ে যাওয়া বইগুলো খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিলেন, আমি বলেছিলাম, ‘বুঝতে পারছি, আপনার আসলে একজন গোয়েন্দা দরকার।’ সঙ্গে সঙ্গেই কাজে নেমে পড়লাম। শেলফ থেকে শেলফ ঘুরে বইগুলো খুঁজে বের করতে থাকলাম।

আমার পরিবার যখন ঠিকানা বদল করল, তখন লাইব্রেরির কাজটা ছাড়তে হবে বলেই সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘হারিয়ে যাওয়া বইগুলো আপনাকে কে খুঁজে দেবে?’ মিসেস ক্যাফিয়েরি বলেছিলেন, আমি নতুন স্কুলেও লাইব্রেরি সহকারী হতে পারি। তিনি বুঝেছিলেন, আমাকে যে শুধু ব্যস্ত রাখা দরকার তা নয়। বরং আমি মূল্যায়ন চাই, সত্যিকার দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ নিতে চাই।

পল স্টকলিন

অষ্টম শ্রেণির গণিত ক্লাসে পল স্টকলিন আমার জীবনে গভীর পরিবর্তন এনেছিলেন দুভাবে, যদিও তখন সেটা বুঝিনি। প্রথমত, সেখানেই আমার কেন্ট ইভান্সের সঙ্গে পরিচয়, পরে যিনি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু আর প্রথম দিককার ‘ব্যবসায়িক’ সঙ্গী হয়েছিলেন।

স্টকলিন স্যারের ক্লাসেই আমি প্রথম টেলিটাইপ মেশিন দেখি। একসকালে তিনি আমাদের পুরো ক্লাসকে নিয়ে গেলেন ম্যাকঅ্যালিস্টার হাউসে। এ ভবনের ভেতর থেকেই অদ্ভুত একটা ‘চাগ-চাগ-চাগ’ শব্দ আসত। ঢুকে দেখলাম, টাইপরাইটারের মতো একটা যন্ত্র, কিন্তু পাশে টেলিফোন ডায়াল। স্টকলিন স্যার বুঝিয়ে বললেন, জিনিসটা টেলিটাইপ মেশিন। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত। এর সাহায্যে আমরা গেম খেলতে পারি, এমনকি নিজেরাই কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখতে পারি। সেই মুহূর্তে আমার সামনে সম্পূর্ণ নতুন একটা জগতের দরজা খুলে গেল।

কেন্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব আর কম্পিউটারের সঙ্গে পরিচয়—আমার শৈশবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সম্পর্ক তৈরি করে দিয়ে আমার জীবন বদলে দিয়েছিলেন স্টকলিন। এগুলো তাঁর দেওয়া উপহার, যা আমি চিরকাল কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব।

আরও পড়ুন

বিল ডগল

আমাদের লেকসাইড স্কুলকে বিশেষ করে তুলেছিলেন বিল ডগল। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের নেভি পাইলট এবং বোয়িংয়ের প্রকৌশলী।

গণিত বিভাগের প্রধান হিসেবে মিস্টার ডগল আমাদের স্কুলে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। যদিও তখন কম্পিউটার ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল—শুধু টার্মিনালের জন্যই বছরে খরচ করতে হতো ১ হাজার ডলারের বেশি।

ডগল স্যার নিজে প্রোগ্রামিং খুব বেশি জানতেন না; কিন্তু তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল। জানতেন এটা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের ওপর তিনি আস্থা রেখেছিলেন, যেন আমরা নিজেরাই শিখতে পারি। ক্যাম্পিংয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে স্যার বেশ বিখ্যাত ছিলেন। ক্যাম্পিং আমাদের শিখিয়েছে দৃঢ়তা, দলবদ্ধতা আর সমস্যা সমাধানের দক্ষতা—যা কোনো ক্লাসরুমে শেখা যেত না।

ফ্রেড রাইট

কম্পিউটার রুমে ফ্রেড রাইট স্যারের প্রয়োজন খুব একটা অনুভব করিনি। বাস্তবে কম্পিউটার ব্যবহারের অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না, যদিও তিনি ফরট্রান প্রোগ্রামিং ভাষা জানতেন। স্বভাবতই তিনি বুঝতেন, শেখানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো শিক্ষার্থীদের নিজেদের মতো করে অনুসন্ধানের স্বাধীনতা দেওয়া। তাঁর শেখানোর পদ্ধতিতে ছিল না কোনো সাইনআপ শিট, তালাবদ্ধ দরজা কিংবা আনুষ্ঠানিক পাঠ।

বরং আমাদের নিজে নিজে বিষয়গুলো আবিষ্কার করতে দিয়েছিলেন মিস্টার রাইট। বিশ্বাস করেছিলেন তাঁর দিকনির্দেশনা ছাড়াই আমরা সৃজনশীল হব। অনেক শিক্ষক কঠোর নিয়মকানুনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মিস্টার রাইট শুধু মাঝেমধ্যে কোনো ঝগড়া থামাতে বা কারও নতুন প্রোগ্রাম শোনার জন্য ক্লাসে ঢুঁ মারতেন। বেশির ভাগ সময় তিনি আমাদের স্বাধীনতাই দিতেন।

ড্যানিয়েল মরিস

ড্যানিয়েল মরিস ছিলেন সাধারণ উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষকদের থেকে একেবারেই আলাদা। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডিধারী। কারখানায় রসায়নবিদ হিসেবে কাজ করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা তিনি ক্লাসে নিয়ে এসেছিলেন। কেউ কেউ ভাবত তিনি একটু দাম্ভিক—কারণ তিনি ল্যাব কোট পরতেন আর কাচের বিকারে কফি খেতেন। কিন্তু তিনি এগুলোর যোগ্য ছিলেন। আমার চোখে তিনিই বিশ্বের সেরা রসায়ন শিক্ষক।

ড. মরিস মুখস্থবিদ্যায় ভরা রসায়নকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করতেন। জটিল প্রক্রিয়াগুলোকে সহজ করতেন দৈনন্দিন উদাহরণের মাধ্যমে—যেমন কেন সোডার বোতলের ঢাকনা লাগালে ভেতরের গ্যাস টিকে থাকে, অথবা কেন সুপারগ্লু এতটা আঠালো হয়।

তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার আগে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো বাস্তবতা দিয়ে বোঝা বা বাস্তবে প্রয়োগ করার প্রতি আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তিনি আমাকে বাধ্য করেছিলেন ল্যাবে গিয়ে পরীক্ষা করতে। আজও আমি আমার বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসার সূত্র তাঁর সেই চাপের মধ্যে খুঁজে পাই, আমাকে যা সত্যিকারের রসায়ন বুঝতে বাধ্য করেছিল। তাঁর কারণেই আমি হার্ভার্ডে অর্গানিক কেমিস্ট্রি পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম (সেই কোর্সে আমি পেয়েছিলাম সি গ্রেড, যা ছিল আমার কলেজজীবনের সবচেয়ে কম নম্বর। কিন্তু সেটা ড. মরিসকে কখনো বলিনি।)

টম চিথাম

হার্ভার্ডের অধ্যাপক টম চিথামের কাছে আমি কৃতজ্ঞ—তিনি আমাকে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ দিয়েছিলেন, কোথাও হস্তক্ষেপ করেননি। আমাকে পিডিপি-১০ কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছিলেন। অথচ সাধারণত এ সুযোগ শুধু স্নাতকোত্তর ছাত্র বা অন্য অধ্যাপকদের জন্য বরাদ্দ থাকত। তখন হার্ভার্ডে এমনকি কম্পিউটারবিজ্ঞানের কোনো স্নাতক বিভাগও ছিল না।

নিশ্চয়ই তিনি আমার মধ্যে কিছু একটা পেয়েছিলেন (আর সেটা পছন্দও করেছিলেন)—হয়তো আমার প্রযুক্তিগত অভিজ্ঞতা, কিশোরসুলভ উদ্দীপনা, অথবা দুটোই। আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষে, আমার প্রকৌশলের একটি স্বাধীন স্টাডি প্রজেক্টের উপদেষ্টা হতে রাজি হয়েছিলেন তিনি। তখন আমি একটি কম্পিউটারাইজড বেসবল গেম তৈরি করছিলাম।

মনে হয় না আমি কোনো দিন আমার শিক্ষকদের যথাযথভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছি। প্রফেসর চিথামসহ অনেক শিক্ষকই আমার ভেতরে এমন কিছু দেখেছিলেন, যা আমি নিজেও সব সময় দেখতে পেতাম না। একজন উজ্জ্বল শিক্ষক, একটি বিস্ময়কর ক্লাসই মানুষের জীবন বদলে দিতে যথেষ্ট। আমি ভীষণ ভাগ্যবান ও কৃতজ্ঞ যে আমি অনেকজনকে পেয়েছিলাম।

আরও পড়ুন