বেইলি রোড অগ্নিকাণ্ডে আহত দোকানকর্মী নিজেই ‍এখন তিন পিৎজা দোকানের মালিক

২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গ্রিন কোজি কটেজ ভবন থেকে নিচে নামার সময় গুরুতর আহত হন সাইফুল ইসলাম। পিৎজার দোকানের এই কর্মী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে এখন নিজেই দিয়েছেন লাইভ পিৎজার দোকান। বছর ঘুরতেই দোকানের সংখ্যাও বেড়েছে। এই তরুণ উদ্যোক্তার কাছ থেকে তাঁর নতুন জীবনের গল্প শুনলেন জাওয়াদুল আলম 

লাইভ পিৎজার দোকান দিয়েছেন সাইফুল ইসলামছবি: প্রথম আলো

দিনটার কথা মনে পড়লে এখনো অসুস্থ হয়ে পড়ি। আগুন থেকে বাঁচতে পাঁচতলার টয়লেটে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা তিন সহকর্মী। টয়লেটের জানালা ছিল বেশ বড়। সেটা খুলে কার্নিশে গিয়ে অবস্থান নিই। পাশের ভবন থেকে একজন ১০-১২ ফুট লম্বা পানি ছিটানোর একটা নরম পাইপ আমাকে ছুড়ে দেয়। জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে সেটা বেয়ে নিচে নামার সময় ছিঁড়ে গেল। তিনতলায় এসির আউটডোরের ওপর পড়ে গেলাম। মাথায় প্রচণ্ড বাড়ি খেয়েছি, টের পেলাম। এরপর আরেকটা কার্নিশে ধাক্কা খেয়ে একেবারে নিচে গিয়ে পড়ি। দুই দফায় ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ার কারণেই হয়তো প্রাণে বেঁচে যাই। প্রায় এক মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। মাথায় অন্তত ২০টি সেলাই পড়েছিল। পাঁজরের হাড়ও ভেঙে গিয়েছিল।

প্রায় তিন মাস শয্যাশায়ী ছিলাম। তখন শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, বড় কোনো বিল্ডিংয়ে আর চাকরি করব না। বড় বিল্ডিং, বদ্ধ পরিবেশে রান্না—এসব শুনলেই তখন আতঙ্ক লাগত। সেই আতঙ্ক এখনো কাটেনি। তাই তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজেই একটা ব্যবসা শুরু করব। ওই অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা দুই সহকর্মী শাকিল আর সিয়ামকে ব্যবসার পরিকল্পনার কথা জানালাম। তাঁরাও আমার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেন। তিনজনেরই যেহেতু পিৎজা বানানোর অভিজ্ঞতা আছে, তাই পিৎজার দোকানই দেব ঠিক করলাম। সব মিলিয়ে আমাদের পুঁজি এক লাখ টাকা। আমার জমানো ৫০ হাজার আর বাকি ৫০ হাজার টাকা দিলেন শাকিল আর সিয়াম। 

সাইফুল ইসলামের ‘পিৎজা ৪৮’
ছবি: প্রথম আলো

ওই টাকার মধ্যেই একটি ভ্যান, পিৎজা বানানোর ওভেন আর টুকিটাকি জিনিস কিনলাম। ২০২৪ সালের মে মাসে আফতাবনগরের আড্ডার মোড়ে চালু হলো আমাদের ফুডকার্ট ‘পিৎজা ৪৮’। অল্প সময়ের মধ্যে আফতাবনগরের বাসিন্দাদের কাছে আমাদের দোকানের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথম দোকানের সাফল্যের পর চলতি বছর নিউমার্কেট ও আফতাবনগর এলাকায় আরও দুটি দোকান চালু করেছি। শাকিল এখনো আমার সঙ্গেই আছেন। তবে সিয়াম বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। 

নতুন দুটি দোকানের মূল মালিক আমি। তবে সেখানকার কর্মচারীরাও ব্যবসার অংশীদার হিসেবে আছেন। অংশীদার বানানোয় কর্মচারীরাও ওই ব্যবসাকে আপন মনে করেন। এখনো বিভিন্ন রেস্তোরাঁ থেকে চাকরির প্রস্তাব পাই। অনেক প্রবাসী বন্ধু আবার দেশের বাইরে গিয়ে স্থায়ীভাবে রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালুর পরামর্শ দিচ্ছেন। 

দুর্ঘটনার পর প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমার জীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। লম্বা সময় উপুড় হয়ে থাকলে বুকে ব্যথা করে। সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালানো নিষেধ। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে নতুন জীবন পেয়েছি বলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিনিয়ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। পরিবারের জন্য এখন বাড়তি টান বোধ করি। দুর্ঘটনার সময় আমার একমাত্র ছেলের বয়স ছিল মাত্র এক মাস। আমার ছেলে এখন একটু বড় হয়েছে। তাই আপাতত পরিবার ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। নিজের ব্যবসা নিয়েই এখন সুখে আছি। স্বপ্ন দেখি, আমার পিৎজা একটা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

আরও পড়ুন