আবু বকর মুক্ত

বাড়ি ফিরলেন আবু বকর। সঙ্গে স্ত্রী রিজওয়ানা হাসান। ছবি: সাজিদ হোসেন
বাড়ি ফিরলেন আবু বকর। সঙ্গে স্ত্রী রিজওয়ানা হাসান। ছবি: সাজিদ হোসেন

অনেকটা কাকতালীয় যোগাযোগই বলা যায়। এক অপহরণের সংবাদ লিখছিলাম, এল আরেক অপহরণের খবর। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল। বিকেলে অফিসে এসে লিখতে বসেছি বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অপহরণের কূলকিনারা না হওয়ার প্রতিবেদন।
এরই মধ্যেই খবর এল নারায়ণগঞ্জে এক লোককে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে গেছে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। কিছুক্ষণ পরই অপহৃত লোকটির পরিচয় জানা গেল। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক। রাতেই ছুটতে হলো নারায়ণগঞ্জ।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে রাতভর প্রচুর মানুষের ভিড়। গণমাধ্যমকর্মীরা আবু বকরের গাড়িচালক মো. রিপনের বক্তব্য, প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের বক্তব্য নিয়ে যে যঁার মতো প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যস্ত। উদ্বিগ্ন রিজওয়ানা হাসান ও তাঁর স্বজনেরা প্রায় সারা রাত কাটালেন থানায়।
পরদিন ১৭ এপ্রিল সকালে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে গিয়ে দেখি কক্ষ ভিড়ে ঠাসা। এসপি সৈয়দ নুরুল ইসলাম একবার গণমাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছেন, আরেকবার ফোনে কথা বলছেন। কখনো কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছিল রাতে তাঁরও ঘুম হয়নি। এর মধ্যেই খবর এল অপহরণকারীদের মাইক্রোবাসের ছবি উঠেছে মেয়র হানিফ উড়ালসেতুর টোলঘরের নিরাপত্তা ক্যামেরায়।
বেলা ১১টার দিকে হাতে এল নেভি ব্লু রঙের সেই টয়োটা হাইয়েস মাইক্রোবাসের ছবি, যেটিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আবু বকরকে। মাইক্রোবাসের নম্বর নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গেল যাচাইয়ের জন্য। খানিক বাদেই জানা গেল নম্বরটি ভুয়া। এমন সময় প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি আসিফ হোসেন জানালেন, ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী আমাদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন। তিনি পেশায় একজন মোটর মেকানিক। আমরা ছুটলাম চাষাঢ়া এলাকায় তাঁর মোটর গ্যারেজে। তাঁর বক্তব্য শুনে মনে হলো, পেশাদার লোকজনই অপহরণকারী। অফিসে ফিরে প্রতিবেদন লিখলাম। সম্পাদনার পর ছাপাতে গেল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১২টা।
প্রধান বার্তা সম্পাদকের ফোন এল রাত দেড়টার দিকে। বললেন, ‘ধানমন্ডি থানায় দৌড় দে। আবু বকর সেখানে আছেন।’ মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলাম।
থানায় ততক্ষণে ভিড় জমেছে। নীল শার্ট পরা সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালককে দেখলাম, থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষের এক কোণে। জিজ্ঞেস করলাম আবু বকর উদ্ধারের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক আছে কি না। তিনি বললেন, আবু বকরকে মিরপুর থেকে সেন্ট্রাল রোডের বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে ধানমন্ডি থানার পুলিশ তাঁদের তল্লাশি করতে আটকায়।
এরপর দেখা মিলল আবু বকর ও রিজওয়ানা হাসানের। এসআইয়ের কক্ষে পাশাপাশি দুই চেয়ারে বসে আছেন তাঁরা। স্বজন, বন্ধু, সহকর্মীরা ঘিরে রেখেছেন। রিজওয়ানার চোখেমুখে কিছুটা স্বস্তির প্রকাশ। সবার সঙ্গে কথা বলছেন হাসিমুখে। আবু বকর জানালেন, অপহরণকারীরা রাত ১০টার দিকে মিরপুর এলাকায় তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। এরপর প্রথমে রিকশা, পরে অটোরিকশায় তিনি সেন্ট্রাল রোডের বাসায় ফেরার চেষ্টা করেন। পথে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে তিনি সব ঘটনা খুলে বললে পুলিশ তাঁকে থানায় এনেছে। সব শুনে তড়িঘড়ি করে অফিসে ফিরলাম। লিখতে হলো দ্রুত। পরদিন প্রথম আলোয় ছাপা হলো সেই প্রতিবেদন। আবু বকর ফিরলেন বটে, তবে কারা, কেন তাঁকে ধরে নিয়ে যায়, সেই রহস্যের জট এখনো খোলেনি।
গোলাম মর্তুজা: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক