আমার প্রথম পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা

শারীরিক অনেক পরিবর্তন টের পাচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে নিজের ভেতর মানসিক পরিবর্তনও বোধ করতে শুরু করলাম। কিন্তু তখন পর্যন্ত পিরিয়ড বা মাসিকের ব্যাপারটা ভালোভাবে জানতাম না। আশপাশে কারও কাছ থেকে সেভাবে শুনিনি।

ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। একদিনের কথা এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। আম্মু আমার পাশে বসে সুন্দর করে পিরিয়ডের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। সেই প্রথম আম্মুর কাছ থেকে পিরিয়ডের ব্যাপারে শুনলাম। সত্যি বলতে, প্রথম শুনে একটু ভয়ই লাগল। কিছুটা অস্বস্তিও বোধ হলো।

আম্মুর কাছ থেকে শোনার পর পিরিয়ডের বিষয়টি সহপাঠীর মুখেও শুনেছি। সেসব কথায় মিশে থাকত ভয়, সংকোচ আর লজ্জা। এভাবে অনেকটা সময় কেটে যায়। অন্য অনেক সহপাঠীর পিরিয়ড হলো। তারা ক্লাসে এসে নিজেদের অভিজ্ঞতা বলত, অনেক সময় সংকোচে আড়ষ্ট হয়ে থাকত। কিন্তু অন্য সহপাঠীদের মতো আমার মাসিক শুরু হলো না। যেহেতু বয়স হওয়ার পরও আমার মাসিক শুরু হচ্ছিল না, তাই সহপাঠীদের মায়েরা এসে আম্মুকে নানা কথা বলতে শুরু করলেন। অনেকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিলেন। তাঁদের কথা শুনে খুব অসহায় লাগত। মনে হতো, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলে তাকে কেন মানসিক অশান্তি দেওয়া!

আরও পড়ুন
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

এখন ভেবে অবাক হই, অনেকে জানেনই না যে বয়ঃসন্ধিকাল শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই সবার মাসিক শুরু হয় না। কারণ, একেকজনের শারীরিক গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং বংশগত জিন ভিন্ন ভিন্ন। অথচ না জেনে আশপাশের মানুষ মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে। এত কম বয়সে অনেকের পক্ষেই এই চাপ গ্রহণ করার মতো অবস্থা থাকে না। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। তবে স্বস্তির ব্যাপার হলো, আমার পরিবার সব সময় আমার পাশে থেকেছে। অনেকে এ সহযোগিতাটুকুও পায় না।

ক্লাস এইটের শেষ কি নাইনের শুরুর দিকে আমার প্রথম পিরিয়ড হলো। আমি তখন স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছি। রক্ত দেখে ভয় পাইনি। কারণ, আম্মু আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, প্রতি মাসেই মেয়েদের মাসিকের মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অনেক কিছু জানার পরও মাসিক শুরুর প্রথম কয়েক মাস খুব অস্বস্তি লাগত। চেনা এই পৃথিবীটা ভীষণ অচেনা লাগতে শুরু করল। হঠাৎ করেই চঞ্চল আমি কেমন যেন শান্ত, সুস্থির হয়ে গেলাম। মাসিক চলাকালে বাইরের পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে খুব কষ্ট হতো। বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছা করত না। স্কুলে যেতে মন চাইত না। পড়াশোনায় মন বসত না। বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছা হতো।

এসব দ্বিধা কাটাতে, অস্বস্তি পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় লেগেছিল। সেই সময়টায় পরিবারের সবাই অনেক সহযোগিতা করেছিলেন। তাঁরা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে মাসিক প্রত্যেক নারীর জীবনে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তাঁদের গড়ে দেওয়া এই মানসিক মনোবলের কারণেই সহজে যা বলা যায় না, তা নিয়ে বড় হয়ে গবেষণা করেছি। বন্ধ্যাত্ব, জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতি, গর্ভপাত, পিরিয়ড, প্রজননস্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকাল ও মাতৃত্বের মতো বিষয়গুলো নিয়ে এখন অবলীলায় কথা বলতে পারছি।

আরও পড়ুন

প্রথম মাসিকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আরেকটা অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছা করছে, সেটা হচ্ছে অনিয়মিত মাসিক। অনেক নারীর মধ্যে ইদানীং এই স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। ওভারিতে সিস্ট হওয়ার কারণে প্রতি মাসে ঠিক সময়ে মাসিক হয় না। কয়েক বছর আগে আমি নিজেও এই স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েছিলাম। কয়েক মাস পরপর মাসিক হতো। ওজন বেড়ে যাচ্ছিল। শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি অনেক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও দেখা দিল। সিদ্ধান্ত নিলাম ওষুধ খাব না, জীবনযাত্রাকে স্বাস্থ্যকর করে তুলব। বাইরের খাবার খাওয়া বাদ দিলাম, বাসায় কম তেলে রান্না করা খাবারে অভ্যস্ত হলাম, মাছ-মাংসসহ অনেক প্রাণীজ খাবার খাওয়া বাদ দিলাম, রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস করলাম, নিয়মিত শরীরচর্চা করা শুরু করলাম, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার চেষ্টা করলাম। ধীরে ধীরে ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে এল এবং মাসিক আবার নিয়মিত হওয়া শুরু হলো। জীবনযাত্রাকে স্বাস্থ্যকর না করে যদি ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যেতাম, তাহলে অনেক শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিত। তাই মাসিক শুরু হলেই যে এটি নিয়মিত হবে, এমন কোনো কথা নেই। জীবনের কোনো একপর্যায়ে গিয়ে আবার অনিয়মিত হতেও পারে। জীবনযাত্রাকে পরিবর্তন করে আবার মাসিককে নিয়মিত করা যায়।

বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের মধ্যে প্রধান যে তিনটি শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়, তার মধ্যে মাসিক একটি। তাই এই বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো নিয়ে যদি খোলামেলা আলোচনা করা হয় এবং সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবেই মাসিক নিয়ে মানুষের মধ্যে লজ্জা আর দ্বিধা কাজ করবে না। সেটা করতে পারলেই কর্মস্থল কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে আমাদের এগিয়ে যাওয়া অনেক সহজ হবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশ