এখনো কর্মব্যস্ত দিন কাটে তাঁর

১৯৭২ সাল। বাংলাদেশে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ঠিক হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সেখানে ফুল দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সোহেলা হোসেন। সোহেলার সঙ্গে কথাবার্তা বলে ইন্দিরা গান্ধী বলে উঠলেন, ‘তোমাকে দেখে, তোমার উর্দু শুনে, তোমার সঙ্গে কথা বলে মনেই হয় না তুমি বাঙালি।’ তখন পাশ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গর্বভরে বলে উঠলেন, ‘ও তো আমার বাংলাদেশের মেয়ে।’

সোহেলা হোসেন মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এনসিসি ব্যাংকের পরিচালক
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সোহেলার জীবনজুড়ে রয়েছে নানি সৈয়দা আহসানা খাতুনের প্রভাব। এই নানিই তাঁর জীবনের আদর্শ। সোহেলার নানি ছিলেন বিহারের অন্তর্গত ভাগলপুর জেলার ডিসির মেয়ে। ১০০ বছর আগের ইতিহাসের সেই পাতা উল্টে সোহেলা বের করলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক সম্পর্কের সূত্র। বললেন, ‘স্বামীর চাকরির সূত্রে তখন ভাগলপুরেই থাকতেন বেগম রোকেয়া। স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল নামে মেয়েদের যে স্কুলটা তিনি প্রতিষ্ঠা করেন, তাতে নানাভাবে সহযোগিতা করেন আমার নানির বাবা। সেই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন আমার নানি আর তাঁর অন্য তিন বোন। ইংরেজি, উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি—এই পাঁচ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন নানি।’

সোহেলার জন্ম ফরিদপুরে, সেখানেই স্কুল আর কলেজ। নানির কাছ থেকে ফারসি শিখে তিনি ম্যাট্রিক আর ইন্টারমিডিয়েট—দুই পরীক্ষাতেই পেয়েছিলেন লেটার নম্বর। ১৯৭০ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে টহল দিত। সেই সময়ের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে সোহেলা বলেন, ‘ঢাকা শহরের এখানে-সেখানে বোমা পড়ত। আর ওরা (পাহারাদার পাকিস্তানি বাহিনী) ভার্সিটির গেটে ঢুকতে গেলে জিজ্ঞেস করত, “তুমনে বোম গিরায়া ক্যা?”’ সোহেলা তখন চার–চারটা বৃত্তি পেতেন। সোহেলা হোসেন স্বল্পভাষী আর খুব পড়ুয়া ছিলেন। কোনো বন্ধু ছিল না। কারও সঙ্গে বিশেষ আড্ডা দিতেন না। বললেন, ‘আমার ব্যাচের একাধিক ব্যক্তি মন্ত্রী হয়েছেন। বড় বড় জায়গায় গেছেন। ওনারা বলেন, আমি নাকি কাউকে চিনতাম না। পেছন থেকে ডাকলেও উত্তর দিতাম না। কারও সঙ্গে বিশেষ কথাও বলতাম না। কেউ কেউ আবার বলত, “ও কানে শোনেও না। কথাও বলতে পারে না।” একটা বিষয়ে আবার ব্যাচের অনেকেই একমত যে আমি ভীষণ অহংকারী। যদিও আমি এগুলোর কিছুই নই।’

নানির ছবি হাতে সোহেলা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

১৯৭৩ সালে শিল্পপতি মীর জাহির হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় সোহেলা হোসেনের। তিন ছেলেকে নিজ হাতে বড় করেছেন। তাঁরা একটু বড় হলে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষকতা করেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ধরেছেন পারিবারিক ব্যবসার হাল। মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেলা হোসেন একই সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে এনসিসি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি এনসিসি ব্যাংকের পরিচালক। ১৯৭৭ সালে তিনি ভয়ংকর অবসাদে পড়েন। সেই থেকে শুরু। এরপর বেশ কয়েকবার হতাশা আর বিষণ্নতায় বিছানায় পড়েছেন। সংগীতই তাঁকে বারবার বাঁচিয়ে তুলেছে। ১৯৮২ সাল থেকে ফজলে নিজামীর কাছে গানের তালিম নিতে শুরু করেন। ফজলে নিজামীর মৃত্যুর আগে শেষ দিনগুলো সোহেলা হোসেনের তত্ত্বাবধানে কেটেছে। সাদি মহম্মদ, তপন মাহমুদ, মহাদেব ঘোষ, খাইরুজ্জামান কাইয়ুমদের কাছে গানের তালিম নিয়েছেন। এখনো মাঝেমধ্যে গান নিয়ে বসেন। নানির কথা মনে করে প্রায়ই গেয়ে ওঠেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান, ‘মরমিয়া তুমি চলে গেলে, দরদি আমার কোথা পাব।’

তরুণেরা আরও বেশি বেশি করে ব্যবসায় আসুক, এই সোহেলা হোসেনের চাওয়া। তিনি মনে করেন বয়স্কদের তুলনায় তরুণেরা বেশি সৎ হয়। যে তরুণ ব্যবসায় আসতে চায়, তার জন্য সোহেলার একটাই পরামর্শ, তারা যেন কর্মীদের দেখে রাখে। যতটা সম্ভব সত্য আর সততার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। সত্তরেও নিয়মিত অফিসে যান। ব্যাংকের মিটিংগুলোতেও অংশ নেন। এরই ফাঁকে চলছে তৃতীয় বইয়ের কাজ। সোহেলা হোসেনকে যখন জিজ্ঞেস করি, জীবনটা আপনার কাছে কেমন? বললেন, ‘আ’ম আ গুড সারভাইভার। আমার পদে পদে কাঁটা বসানো ছিল। সেগুলো পার করেছি। ব্যস্ততায় দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। জীবন কেটে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বেঁচে থাকা মন্দ নয়।’