কাজুতে কিস্তিমাত করেছেন এই দুই নারী উদ্যোক্তা

শিরীন সুলতানা ও জবা তাঞ্চঙ্গ্যা দেশে উৎপাদিত কাজু বাদামের ব্যবসা করে পরিচিতি পেয়েছেনপ্রথম আলো কোলাজ

পার্বত্য চট্টগ্রামের হস্তজাত শিল্প অনলাইনে বিকিকিনি করে বেশ চলছিল। কিন্তু করোনার পর থেকেই ব্যবসা মন্দ। কী করবেন এই ভেবে শিরীন সুলতানা যখন ব্যাকুল, তখন তাঁকে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘উই’য়ে জয়েন করিয়ে দেন তাঁর স্বামী। শিরীন ভাবলেন, ‘কোন পণ্য নিয়ে কাজ করব? তখনই মনে হলো, যেহেতু রাঙামাটি থাকি, স্থানীয় কাজুবাদাম নিয়ে কাজ করি।’ সেই চিন্তা থেকেই দেশি কাজুবাদাম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। কাজুবাদাম নিয়ে গ্রাহকদের কী প্রশ্ন থাকতে পারে, তা চিন্তা করতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলায় কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করলেন। এরই মধ্যে এসএস এগ্রো প্রোডাক্ট নামে একটি অনলাইন পেজ খুলে ফেলেন শিরীন সুলতানা। উই এবং এই পেজে কাজুবাদাম নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম থেকেই ব্যাপক সাড়া পান। দেশে যে কাজুবাদাম হয়, তা-ই অনেকে জানতেন না।

রাঙামাটি শহরে তিন মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে শিরীনের সংসার। ঘরের কাজ সামলানোর পর বাকি সময় কাজুর ব্যবসায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেছেন। এই কয়েক মাসের ব্যবসায় দেশের ৬৪ জেলায় পার্বত্য অঞ্চলের কাজুবাদাম পৌঁছে দিয়েছেন। বিক্রি করেছেন প্রায় ২২ লাখ টাকার দেশি কাজুবাদাম।

শিরীন সুলতানা
ছবি: সংগৃহীত

শিরীন বলেন, ‘অনেকে এখন আমাকে কাজু আপা নামেই চেনেন। আমার লেখার মাধ্যমে অনেক মানুষ পাহাড়ের কাজুবাদাম সম্পর্কে জানেন। আমার স্বপ্ন একদিন কাজুবাদামের একটা ফ্যাক্টরি করব।’

শিরীনের মতো পুরোনো উদ্যোক্তাকে যেমন নতুন করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে কাজু, আবার জবা তঞ্চঙ্গ্যার মতো নবীনদের জীবনে চলার স্বপ্ন দেখাচ্ছে কাজু। রাঙামাটি সদরের ঝগড়াবিল তঞ্চঙ্গ্যাপাড়ায় থাকেন জবা। বাবা ও মা দুজনেই কৃষক। পরিবারে আর একটি ভাই আছে। রাঙামাটি সরকারি কলেজে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন জবা। লেখাপড়া চালানোর জন্য বাড়তি আয়ের ভাবনা থেকেই অনলাইন ব্যবসা শুরু করেন তিনি। রাসায়নিকমুক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য নিয়ে ২০২০ সাল থেকে কাজ করছেন। এরপর কাজুর ব্যবসায় আসা। এখন অনলাইনে ‘রাঙামাটি ই-কমার্স ফোরাম’ গ্রুপের মাধ্যমে এবং সেই সঙ্গে বাসা থেকেও বিক্রি করেন কাজু।

শুরুতে ৯০০ টাকা কেজিতে কাজু বিক্রি করতেন জবা। এখন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা দাম হয়ে গেছে। দিন দিন চাহিদাও বাড়ছে। জবা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘এটা খুবই ভালো লাগার যে স্থানীয় একটি পণ্য নিয়ে কাজ করছি। এখানে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে, আমরাও লাভের মুখ দেখছি।’

চাকরি নিয়ে তরুণদের মধ্যে কত হতাশা অথচ চাকরির ভাবনাই করেন না জবা। ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, প্রয়োজনে অন্যকে চাকরি দেবেন, এমনই তাঁর প্রত্যয়।

জবা তঞ্চঙ্গ্যা
ছবি: সংগৃহীত

পাহাড়ে যেভাবে কাজু এল

১৯৬৭ সালে থাংচুল বম নামের এক শিক্ষক বান্দরবানের বেথেলপাড়ায় প্রথম কাজুবাদামের গাছ লাগান। শুরু হয় সীমিত আকারে কাজুর চাষ। এর আগে ১৯৬২ সালেও কাপ্তাই লেক পুনর্বাসন এলাকায় কাজুবাদামের চারা দেওয়া হয়েছিল। তবে বাণিজ্যিকভাবে তখন ততটা প্রসার লাভ করেনি।

১৯৭৬ সালের দিকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রুমার বেথেলপাড়ায় ১৫ পরিবার এবং পাইন্দু এলাকায় ১০ পরিবার কাজুবাদামের চাষ শুরু করে। প্রথম দিকে কাজুবাদাম বিক্রি হতো না। ১৯৮০ সালের দিকে কাজুবাদাম বিক্রি শুরু হয়। আর এখন তো তিন পার্বত্য জেলাতেই কাজুর চাষ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পার্বত্য এলাকায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭৬৭ একর জমিতে কাজুর আবাদ হয়। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ হাজার ৩০৮ একর জমিতে চাষ হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’ কাজু চাষের সম্প্রসারণে কাজ করছে। এ প্রকল্পের পরিচালক মেহেদি মাসুদ বলেন, কাজুর সম্প্রসারণের জন্য পার্বত্য এলাকায় ইতিমধ্যে চারটি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা করা হয়েছে। কাজু ব্যবসায় নারীদের এগিয়ে আসার খবরটি নিঃসন্দেহে আনন্দের।