নানা কারণে বেড়ে চলেছে ‘রুরাল টু গ্লোবাল’ সম্পর্ক। ইংরেজিতে যাকে কায়দা করে ডাকা হয় ‘লং ডিসট্যান্স রিলেশন’। যুগ যুগ ধরেই চলে এসেছে এই ধারা। আর তাই কবুতরের পায়ে বাঁধতে হয়েছে চিরকুট, বার্তা লিখে পাঠাতে হয়েছে বাহকের হাতে। ডাক যুগের পর তো চিঠি লিখে বন্ধুর কাছে মনের খবর পাঠানো যেত সহজে। তবে এই সময়ে দূরের সম্পর্ক ঠিক রাখতে আর অপেক্ষা করতে হয় না কয়েকটি দিনও। মন চাইলেই ভিডিও কল বা ইনবক্সে মুহূর্তেই কথোপকথন সম্ভব হচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতিতে সম্পর্কগুলো এখন সহজতর। পড়াশোনা বা কাজের কারণে সঙ্গীর কাছ থেকে দূরে থাকা নিয়ে তাই খুব বেশি দুশ্চিন্তা কাজ করে না এখন। তবে এ ধরনের সম্পর্কে তৈরি করেছে আরেক জটিল পরিস্থিতি। যার কারণে অনেক সম্পর্ক শেষ হচ্ছে তিক্ততায়। ভুল–বোঝাবুঝিও থেমে নেই। প্রযুক্তি যতটা সহজ করেছে, আমরা যেন ততটাই অধৈর্য হয়ে উঠেছি। কয়েক মিনিটের অপেক্ষাও এখন অসহ্য লাগে। আর তাই তো দূর থেকে সঙ্গীকে একবারে ফোনে না পেলে ওপাশ থেকে বিরক্ত মেশানো প্রশ্ন, ‘কোথায় থাকো, ফোন ধরতে পারো না?’
দুজন দুই জায়গায় থাকা সম্পর্কগুলো মূলত দুজনকেই যত্নে রাখতে হয়। এককভাবে এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা দুষ্কর। এ ধরনের সম্পর্কে মূলত বোঝাপড়ার গুরুত্ব অনেক। জেনে নিন, এই সম্পর্ক প্রাণবন্ত, হাসিখুশি আর ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখতে কোন বিষয়গুলোতে খেয়াল রাখা জরুরি।
দুজন মানুষকে প্রথমে ঠিক করে নিতে হবে কিছু বিষয়, যাতে ছোট ছোট ভুল–বোঝাবুঝি বা সন্দেহ তৈরি না হয়। দুজনকেই অটল থাকতে হবে নিজেদের সিদ্ধান্তের ওপর।
দূরত্বের কারণে সময়ের ব্যবধান থাকতে পারে দুজনের। তাই নির্দিষ্ট সময় আলাদা করে রাখুন নিজেদের জন্য। খেয়াল রাখবেন দুজনের জন্যই সুবিধার হয়, এমন কোনো সময় বেছে নিতে হবে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। সারা দিনের কথাগুলো নিজেদের মতো করে শেয়ার করুন একজন আরেকজনের সঙ্গে।
দুজনই নিজেদের বিশ্বাসের জায়গাটায় অটল থাকুন। সময় দিন যথাযথ। কোনো বিষয় কানে এলে সেটা সঙ্গীর কাছ থেকে শোনা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। নিজে থেকে না জেনে, না বুঝে মনের আন্দাজে কিছু ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না। সন্দেহ করে সুন্দর সম্পর্ক খারাপ করবেন না।
অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অবস্থান নিজেই পরিষ্কার রাখুন। চ্যাটবক্সে সবুজবাতি জ্বলছে কিন্তু যোগাযোগ কেন করছে না আমার সঙ্গে! এ ধরনের প্রশ্ন ভুল–বোঝাবুঝির বড় একটি কারণ। তার অনলাইন সবুজ মানেই অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছেন, এমনটি ভাবলে আস্থা কমে গিয়ে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়। এমন ভাবনা দূরে রাখুন।
আপনাদের নিজেদের বন্ধু বা কাজ নিয়ে কথা বলুন। নিজের মানসিক অবস্থা বা অনুভূতির কথা খুলে বলুন। তার প্রশংসা করুন।
কোথাও দাওয়াতে বা বেড়াতে গেলে কী কী দেখলেন, খেলেন, কীভাবে গেলেন, সঙ্গে কারা ছিলেন এবং কেমন অনুভূতি হচ্ছিল—সম্ভব হলে এই সবকিছুই সঙ্গীকে বলুন।
দূরের সম্পর্ক ঠিক রাখতে নির্দিষ্ট সময় পরপর দেখা করা জরুরি। একসঙ্গে নেটফ্লিক্স বা ইউটিউবে পছন্দের সিনেমা দেখুন।
অনেক দূরে থাকলে এবং মাঝে অনেক দিন দেখা না হলে প্রয়োজনে এবং সামর্থ্য বুঝে মাঝামাঝি কোনো দূরত্ব বেছে নিয়ে নিজেদের সুবিধামতো দেখা করে আসতে পারেন। এতে আবেগীয় ব্যাপারগুলো কিছুটা ভারসম্য বজায় রাখা সহজ হবে।
অনেক দিন পর দেখা হলে পরিবার, বন্ধু, পরিজনকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি সঙ্গীকে সময় দিচ্ছেন কি না বা পরিবারকে সময় দিচ্ছেন কি না—এই জায়গায় একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারও কাছ থেকে কিছু শুনেই সঙ্গে সঙ্গে সেটা নিয়ে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজেকে সংযত করুন। কারণ, পরবর্তী সময়ে এই ইস্যুগুলো দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের সূত্র তৈরি করে সম্পর্ককে প্রশ্নের মুখে ফেলে দুর্বল করে দেয়।
বিপরীত লিঙ্গের কোনো বন্ধুর সঙ্গে আপনার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলে সেটা আপনার সঙ্গীর সন্দেহ বা কষ্টের কারণ হতে পারে। তাই আপনার সঙ্গী কখনো এমনটা যেন ভাবতে না পারে। প্রয়োজনে এমন বন্ধুকে এড়িয়ে চলুন। পরিচ্ছন্ন বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক রাখুন বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুর সঙ্গে।
যত দূরেই থাকুন, পারিবারিক যেকোনো সিদ্ধান্ত অবশ্যই দুজনে মিলে নিতে হবে। সময় করে বিশদ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে একজনের প্রতি অন্যজনের আস্থা, বিশ্বাস ও সম্মানের জায়গাটা গভীর হবে।
বিশেষ দিনগুলোতে চমকে দেওয়ার মতো উপহার দিন। তবে উপহার বাছাই করতে প্রতিদিনের যোগাযোগ থেকেই ক্লু বের করে নিন। বিভিন্ন সময় কথা বলার ফাঁকে নিজেদের কোনো জিনিস ভালো লাগলে সেটা সঙ্গীকে বলে থাকি আমরা। আর সেই অপূর্ণ ইচ্ছে যদি আপনার চমক চলে আসে, তাহলে সে আপনার প্রতি আরও কৃতজ্ঞ থাকবে।
সব মিলিয়ে অনুভূতির এবং ভালোবাসার কথা বলে, নিজের মধ্যে যতটা সম্ভব মনের দূরত্ব কমিয়ে লং ডিস্ট্যান্স সম্পর্ককে সুন্দর রাখতে পারেন। গবেষণা বলছে, অনেক দম্পতি দূরত্ব বেশি নিয়েও কাছে থাকা দম্পতির চেয়ে অনেক রোমাঞ্চকর এবং গভীর হতে পারেন। দরকার শুধু নিজেদের মধ্যে একটি সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলা।
লেখক: বিয়েবিষয়ক পরামর্শক