নারীর উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পাওয়া উচিত

আসছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট। নারীর উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পাওয়া উচিত? মত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের কথা শুনেছেন জান্নাতুল ফেরদৌসী

কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় নারীদের নিযুক্ত করতে হবে

নাজনীন আহমেদ, কান্ট্রি ইকোনমিস্ট, ইউএনডিপি

নারীর জন্য প্রচলিত বরাদ্দের পাশাপাশি সরকারকে কয়েকটি বিষয়ে অতিরিক্ত মনোযোগ দিতে হবে। এ মুহূর্তে অতি ক্ষুদ্র নারীপ্রধান খানার সমস্যা পুরুষপ্রধান খানার তুলনায় বেশি। তাই অতিদরিদ্র নারীদের জন্য বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার পাশাপাশি শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছেন, এমন মায়েদের জন্য ভাতার পরিমাণ ও আওতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সরকারের কর্মসৃজনমূলক কর্মসূচিতে নারীর জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে, যাতে তাঁরা সেই বরাদ্দের আওতায় কাজ পেতে পারেন।

নাজনীন আহমেদ, কান্ট্রি ইকোনমিস্ট, ইউএনডিপি
ছবি: প্রথম আলো

করোনার প্রকোপ কম গেলেও অনেকে এখনো তাঁরা তাঁদের ব্যবসায় ফিরতে পারেননি। অনেকেই ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। করোনার সময় যেসব নারীর ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে, তাঁদের সহযোগিতার জন্য সরকারের উদ্যোগ থাকা উচিত।

সর্বোপরি নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, বিশেষ করে নিরাপদ শহর, যানবাহন এসব ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি শিশু দিবাযত্নকেন্দ্রের সুবিধা যেন বিভিন্ন জায়গায় থাকে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং বরাদ্দ দিতে হবে। এতে করে অনেক নারী নতুন করে কাজে আসার সুযোগ পাবেন।

এ ছাড়া নারী উন্নয়নে বাজেট কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, সে–সংক্রান্ত কোনো গবেষণা নেই। এ বিষয়টিও পর্যালোচনায় থাকা উচিত।

জেন্ডার বাজেটকে আরও সংবেদনশীল করতে হবে

সায়েমা হক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গত অর্থবছরে আমাদের ছোট ছোট কর্মপরিকল্পনা ছিল। তবে চাহিদার তুলনায়, অর্থাৎ অর্ধেক জনগোষ্ঠী বিবেচনায় উদ্যোগগুলো যথেষ্ট নয়, একেবারেই অপ্রতুল। বাজেট বরাদ্দে নারীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে দুস্থ নারীদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন কর ছাড়সহ বিশেষ কিছু সুবিধা থাকা দরকার।

যেসব প্রতিষ্ঠান নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে, তাদের জন্য সরকার বিশেষ কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে পারে। অর্থাৎ, নারীদের জন্য কাজ ও কাজের বাইরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারে। তাদের শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে।

সায়েমা হক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: প্রথম আলো

আমাদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহ, নিরাপত্তার অভাব, সঠিক কর্মপরিবেশের অভাব অন্যতম। এই তিন বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও বরাদ্দ থাকা দরকার। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা গেলে নারীরাই অধিকাংশ সুবিধা পাবেন। এ বিষয়গুলোই মূলত গোড়ার বিষয়। গোড়ার বিষয় পরিবর্তন না করলে আমরা বড় পরিবর্তন দেখব না।

বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের কথা বলা থাকলেও আমরা কিন্তু কাগজে–কলমে এর প্রতিফলন দেখি না। আমাদের চাহিদার তুলনায় উদ্যোগগুলো অপ্রতুল। সে জায়গাগুলোতে বরাদ্দ ও কর্মপরিকল্পনা ব্যাপক হারে বাড়ানো দরকার। জেন্ডার বাজেট হওয়ার পাশাপাশি সেই বাজেট কতটা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে, তার পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন দরকার। জেন্ডার বাজেটকে আরও সংবেদনশীল করতে হবে। মেয়েশিশু ও ছেলেশিশুর মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য কাজ করবে, এমন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন।

জেন্ডার বাজেট বা জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট নারীর জন্য পৃথক বাজেট নয়। নারী ও পুরুষের ওপর বাজেটের যে পৃথক প্রভাব এবং নারী-পুরুষের চাহিদার যে ভিন্নতা, তাকে আমলে নিয়ে বাজেট বরাদ্দকে বোঝায়।

মূল্য সংযোজন কর ৫ শতাংশ করতে হবে

মৌসুমী ইসলাম, সভাপতি, তৃণমূল নারী শিল্প উদ্যোক্তা সমিতি, বাংলাদেশ

আসন্ন বাজেটে নারীদের জন্য ব্যক্তিগত আয়করসীমা সাড়ে তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে চার লাখ টাকা করতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বার্ষিক আয়করসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৭০ লাখ টাকা। এর পরিমাণ এক কোটি টাকা করা হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নারী উদ্যোক্তাদের আগ্রহ আরও বাড়বে। নতুন যেসব শিল্পোদ্যোক্তা ব্যবসা করছেন, তাঁদের যদি ব্যবসা শুরুর প্রথম তিন বছর করের আওতার বাইরে রাখা হয়, তবে তাঁরা ব্যবসার উন্নতি করতে পারবেন।

মৌসুমী ইসলাম, সভাপতি, তৃণমূল নারী শিল্প উদ্যোক্তা সমিতি, বাংলাদেশ
ছবি: সংগৃহীত

এ ছাড়া করোনার কারণে অনেক ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের নারী উদ্যোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য বর্তমান আইনে মূল্য সংযোজন কর হার ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এই করের পরিমাণ কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হলে ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসায় উন্নতি করতে পারবেন এবং ট্রেড লাইসেন্স ফি যদি ৫০ শতাংশ কমানো হয়, অর্থাৎ অর্ধেক করা হয়, তবে উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন।