নারীর 'অদৃশ্য' কাজের হিসাব নেই

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি
>

* নারীর গৃহস্থালি ও বেতনহীন কাজের স্বীকৃতি দেয়নি পরিবার ও রাষ্ট্র
* জিডিপিতে এ কাজ অন্তর্ভুক্তির জুতসই পদ্ধতিও নেই

নারীরা ঘরে কীই–বা এমন কাজ করে? তা বলার দিন শেষ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় সংস্থার গবেষণায় নারীর কাজের কর্মঘণ্টা, হিসাব-নিকাশ সব বের হয়ে গেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে নারীর গৃহস্থালির কাজের হিসাবকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া এবং মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

১৯৯৫ সালে বেইজিং সম্মেলনের প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশনে নারীর কাজের পরিধি, মূল্যহীন কাজকে দৃশ্যমান এবং মূল্যায়িত করতে একটি ‘জুতসই’ পরিসংখ্যান পদ্ধতি বের করার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতেও (এসডিজি) গৃহস্থালির কাজকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি মূল্যায়নের কথা বলা আছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।

যে কাজগুলো নিয়মিত ঘরে করা হয়, কিন্তু তার স্বীকৃতি, মূল্যায়ন ও আর্থিক মূল্য নেই, সেই কাজগুলোকেই গৃহস্থালির কাজ বলা হয়। সন্তান লালন, পরিবারের প্রবীণ সদস্যের দেখভাল, ঘরের কাজ—সবই এর আওতায় আছে। এখন পর্যন্ত এই কাজগুলোকে নারীর কাজ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় এবং বিশ্বব্যাপী প্রবণতা প্রায় একই রকম।

গত বছর প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘কেয়ার ওয়ার্ক অ্যান্ড কেয়ার জবস ফর দ্য ফিউচার ডিসেন্ট ওয়ার্ক’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নারীরা পুরুষের তুলনায় চার গুণের বেশি সময় গৃহস্থালি ও বেতনবিহীন কাজে ব্যয় করছেন। বিশ্বের ৬০৬ মিলিয়ন কর্মক্ষম নারী জানিয়েছেন, গৃহস্থালির কাজের চাপে ঘরের বাইরে কোনো চাকরি করার সুযোগ পাননি। আর এ অভিজ্ঞতা থাকা পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪১ মিলিয়ন।

আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবারের মূল উপার্জনকারী বা রুজিদাতা হবেন পুরুষ অর্থাৎ ‘মেল ব্রেডউইনার ফ্যামিলি মডেল’–এর ক্ষেত্রেও মনোভাব খুব একটা পাল্টায়নি।

বাংলাদেশের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, ২০১২ সালেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘টাইম ইউজড সার্ভে’ বলেছিল, ১৫ বছরের বেশি বয়সী কর্মজীবীদের মধ্যে ঘরের বিভিন্ন কাজে পুরুষ দৈনিক ১ দশমিক ৪ ঘণ্টা এবং নারী ব্যয় করেন ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টা। কর্মজীবী না হলে গড়ে নারীরা দিনে ৬ দশমিক ২ ঘণ্টা এবং পুরুষ ১ দশমিক ২ ঘণ্টা এ ধরনের কাজে ব্যয় করেন।

আর ২০১৭ সালে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের একটি গবেষণায় গাইবান্ধা ও লালমনিরহাটে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজে মোট ব্যয়িত সময়ের হিসাব বলছে, এই দুই জায়গায় নারী গড়ে ব্যয় করেন ৭ দশমিক ৫০ ঘণ্টা আর পুরুষ ব্যয় করেন ২ দশমিক ৩৭ ঘণ্টা। এই দুই এলাকার নারীরা ‘টাইম ইউজ ডায়েরি’ ব্যবহার করছেন ২০১৩ সাল থেকে।

২০১২ সাল থেকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন গৃহস্থালির কাজসহ মজুরিবিহীন কাজের মাধ্যমে নারীর অবদানকে তুলে ধরার জন্য ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’ শীর্ষক একটি প্রচারাভিযান শুরু করে। ২০১৪ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ যৌথভাবে ‘জাতীয় অর্থনীতিতে নারীদের অবদান নিরূপণ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ গবেষণা করে। এ গবেষণার ফলাফল বলছে, নারী প্রতিদিন গড়ে ১২টির বেশি মজুরিবিহীন কাজ করেন, পুরুষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজের সংখ্যা মাত্র ২ দশমিক ৭টি। এ কাজের হিসাব নেই জিডিপিতে।

কাজের ছায়ামূল্য ব্যবহার করে সিপিডি প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে দেখিয়েছে, জাতীয় আয় হিসাবে (জিডিপি) অন্তর্ভুক্ত হয় না এমন কাজ, যা নারীরা করছেন তার আনুমানিক বার্ষিক মূল্য (২০১৩-১৪ অর্থবছর) জিডিপির প্রায় ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশের সমপরিমাণ। এ ধরনের হিসাব যোগ হলে জাতীয় উৎপাদনে নারীর অবদান ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশে পৌঁছাবে। তথ্য বলছে, পরিসংখ্যানের বাইরে থাকা কাজের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগের অবদান নারীর আর পুরুষের অবদান ৫ ভাগ।

আইএলওর প্রতিবেদনে নারীর অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে গৃহস্থালির বেতনহীন কাজকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দেশের নীতিকাঠামোতে দুর্বলতা চিহ্নিত করা, মানুষের চিন্তা ও আচরণে পরিবর্তন আনা, স্বীকৃতির পাশাপাশি পুনর্বণ্টন, কাজের চাপ কমানোর জন্য ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করাসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গত বছর অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মফিজুর রহমান ‘গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি, পুনর্বণ্টন ও হ্রাস: বাংলাদেশে নীতিকাঠামোগত দিক’ শীর্ষক একটি পলিসি ব্রিফ প্রণয়ন করেন।

এতে নারীর ক্ষমতায়ন এবং লৈঙ্গিক বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে গৃহস্থালির সেবামূলক কাজকে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি নারী সারা জীবনে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, বাক্-স্বাধীনতার অধিকার ভোগসহ অনেক অধিকার ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।

ঘর ও বাইরে কাজের চাপ সামলাতে না পেরে একটি ভালো চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসিন্দা ফাতেমা পারভীন (ছদ্মনাম)। এমএ পাস করা এ নারীর ক্ষোভ একটাই, তা হলো পরিবারের সদস্যরা তাঁর এ কাজের জন্য কখনো স্বীকৃতিও দেন না। স্বামী সবার সামনেই বলেন, তাঁর স্ত্রী কোনো কাজ করেন না। আর ফাতেমা নিজেও এখন নিজের পরিচয় ‘হাউস ওয়াইফ’ দিয়ে অবলীলায় বলেন, তিনি কোনো কাজ করেন না। তবে এক-দুই দিন অসুস্থ হলে ফাতেমার কাজ যখন টাকার বিনিময়ে অন্যকে দিয়ে করাতে হয়, তখন তাঁর মূল্য পরিবারের সদস্যরা ভালোই বুঝতে পারেন।

তবে নারীর এই দুঃখ ঘোচাতে সরকার নীতিকাঠামোতে কতটুকু পরিবর্তন এনেছে, তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় অধ্যাপক মফিজুর রহমানের পলিসি ব্রিফে। এতে বলা হয়েছে, সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সেবামূলক কাজের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো সূচক নির্ধারণ করা হয়নি। ন্যাশনাল সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজি (২০১০-২১) সেবামূলক কাজের প্রসঙ্গ একেবারেই এড়িয়ে গেছে। শ্রম আইন বা অন্যান্য শ্রমসংক্রান্ত নীতিতেও বিষয়টি আসেনি। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ বাস্তবায়নে ২০১৩ সালের জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি এবং জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। তবে এতে বাস্তবায়নের উপায় বাতলে দেওয়া হয়নি।

বিভিন্ন গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মতে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারীর অসংখ্য কাজের মধ্যে কোন কাজটি মূল কাজ বা প্রাথমিক উৎপাদন, তা ঠিক করা হয়নি। অথচ জিডিপি মাপার পদ্ধতিই এমন যে মূল কাজ না হলে তা হিসাবের মধ্যে ধরা হয় না।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলছেন, নারীর গৃহস্থালির কাজের স্বীকৃতি না থাকার ফলে ঘরের ভেতরে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটছে। সরকারকে অতিদ্রুত জাতীয় হিসাব পরিমাপের এমন একটি পদ্ধতি বের করতে হবে, যাতে নারীদের বেতনহীন কাজ জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, মেক্সিকো, ভারত ও নেপালের মতো কয়েকটি দেশ ‘স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম’ নামে একটি পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে, যাতে প্রতীকীভাবে হলেও নারীদের বেতনহীন কাজকে হিসাবের মধ্যে এনে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকারবিষয়ক ‘পাওয়ার’ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. হেলাল উদ্দিন জানালেন, কমিউনিটি পর্যায়ে পপুলার থিয়েটারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনতা তৈরির ফলে গৃহস্থালি কাজের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা কমছে এবং পুরুষের অংশগ্রহণ কিছুটা বাড়ছে। এখন দরকার সরকারের পক্ষ থেকে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া। নারীর কাজের বোঝা কমলে নারী বাইরে উৎপাদনমূলক কাজে অংশ নিতে পারবেন। আর এই বোঝা কমানোর জন্য শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র তৈরিসহ যেসব উদ্যোগ নেওয়া হবে, তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে, যা দেশের উন্নয়নেই ভূমিকা রাখবে।