যেভাবে আমি প্রত্নতাত্ত্বিক

সরকারি কর্মকর্তা হয়েও কীভাবে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলেন তিনি, হয়ে উঠলেন এদেশে প্রত্নতত্ত্বচর্চার পথিকৃৎ? এই লেখায় উঠে এসেছে সেই কাহিনি

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। ছবি: জিয়া ইসলাম
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। ছবি: জিয়া ইসলাম

১৯৪৬ সাল। আমি তখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সে সময় ওই কলেজের অধ্যক্ষ। একদিন রংপুর কারমাইকেল কলেজের কিছু ছাত্র মহাস্থানগড় ভ্রমণের উদ্দেশে এল আমাদের কাছে। তারা এ বিষয়ে সাহায্য করতে অনুরোধ করল আমাদের। এ সময় ড. শহীদুল্লাহ তাদের সঙ্গে মহাস্থানগড় যাওয়ার অনুরোধ করলেন আমাকে। এর আগে আমি মহাস্থানগড় দেখিনি। তাই মহাস্থানগড় ভ্রমণের প্রস্তাবটি আমার কাছে ছিল নতুন কিছু দেখার আমন্ত্রণের মতো। 
মহাস্থানগড়ে পৌঁছে আমি তো হতবাক! চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রচুর প্রত্নসামগ্রী। নৃতত্ত্ব বিষয়ে আমার খানিকটা আগ্রহ থাকলেও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে বিশেষ কোনো জ্ঞান ছিল না। মহাস্থানগড় ভ্রমণ আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করল। বলতে পারি, এই ভ্রমণ আমার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাবও বিস্তার করেছিল। দিনে দিনে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহ জাগল আমার।
এর কিছুদিন পর কলেজের চাকরি ছেড়ে আমি যোগ দিলাম ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক শাখায়। ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর চট্টগ্রাম-ঢাকা-ফরিদপুরে চাকরি শেষে ১৯৫৮ সালে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে গেলাম যুক্তরাষ্ট্রে। তো, ওই প্রশিক্ষণের মধ্যে ৪৫ দিনের ছুটি নিয়ে ঘুরলাম পুরো ইউরোপ। আমার এ ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রিস, ইতালি ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখা। এইসব ঐতিহাসিক স্থানের প্রত্ননিদর্শন দেখে আমি তো অভিভূত। এখানে এটিও বলা প্রয়োজন, ১৯৪৬-এ যে মহাস্থানগড় পরিদর্শন করেছিলাম, সেই ভ্রমণই আমাকে প্রভাবিত করেছিল ইউরোপের প্রাচীন প্রত্ননিদর্শনগুলো ঘুরে দেখতে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর যোগ দিলাম দিনাজপুর জেলার জয়েন্ট কালেক্টর অব রেভিনিউ হিসেবে। সেখানে প্রায় দুই বছর অবস্থানকালে ঘুরে বেড়িয়েছি দিনাজপুরের বিভিন্ন জায়গায়, প্রথমত পেশাগত কারণে; দ্বিতীয়ত প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আমার আগ্রহ থেকে। দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় আমি লক্ষ করলাম প্রচুর উঁচু ঢিবি বা স্তূপ। শুধু বিরামপুর, নওয়াবগঞ্জ, ঘোড়াঘাট আর গোবিন্দগঞ্জ (রংপুর) এলাকাতেই প্রায় ৫০০-৬০০ উঁচু ঢিবি দেখেছি। এগুলো প্রায় সবই ছোট-বড় প্রত্ননিদর্শন, কালের বিবর্তনে যা মাটিচাপা পড়ে গেছে।
এই ঘোরাঘুরির মধ্যেই নজরে এল চরকাই-বিরামপুর থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার পূর্বে সীতাকোট নামে একটি বাঁধানো পুকুর। কিন্তু এটিকে ঠিক পুকুর হিসেবে মেনে নিতে মন সায় দিচ্ছিল না আমার। আশপাশের সাধারণ মানুষের কাছে এটি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে বর্ণিত সীতার দ্বিতীয় বনবাসের স্থান। এ কারণেই এটির নাম সীতাকোট। মি. ওয়েস্টমেকটও (পাহাড়পুর বিহারখ্যাত) এটিকে মজে যাওয়া বাঁধানো পুকুর হিসেবে নথিভুক্ত করেছিলেন।

দিনাজপুরের সীতাকোট বিহার
দিনাজপুরের সীতাকোট বিহার

কিন্তু ওই স্থানটিকে নিছক পুকুর বলে মানতে চাইল না আমার মন। তাই নিজের উদ্যোগে এই এলাকাটি খুব গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকলাম আমি। এরপর আমার বদ্ধমূল ধারণা হলো যে এটি একটি বৌদ্ধবিহার। সে সময় আমার আগ্রহ আর ঘন ঘন সীতাকোট ভ্রমণে অনেকেতই বিস্মিত হতেন। দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা কালেক্টর তো আমার এই আগ্রহকে এক ধরনের পাগলামি মনে করতেন। তবে সীতাকোট নিয়ে আরও অগ্রসর হওয়ার আগেই দিনাজপুর থেকে আমি বদলি হয়ে গেলাম অন্য জায়গায়।
১৯৬৭ সাল। আবার ফিরে এলাম দিনাজপুরে, জেলা প্রশাসক হিসেবে। এবার আবার নতুন উদ্যমে শুরু করলাম কাজ—উদ্যোগ নিলাম সীতাকোট বিহার খননের। এ সময় খননকাজের জন্য অর্থ সাহায্য চেয়ে পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে একটি চিঠিও দিলাম। পরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তহবিলের নিশ্চয়তা দিলে শুরু হলো খননকাজ। এটা ১৯৬৮ সালের ঘটনা। এর মধ্যে একদিন আমি দিনাজপুর জেলা পরিষদের সভায় প্রস্তাব করলাম, সীতাকোট বিহার দিনাজপুরের একটি প্রত্নসম্পদ এবং এটির খনন ও সংরক্ষণের দায়িত্ব দিনাজপুর জেলা পরিষদের। বেশ কাজ হলো এতে। জেলা পরিষদ থেকে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ হলো। ওই সময় প্রতি সপ্তাহে দুই-তিনবার খননকাজ দেখতে সীতাকোট বিহারে যেতাম আমি। এ দফায় সীতাকোট বিহারের প্রাথমিক খননকাজ শেষ হলো; পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হলো যে এটি একটি বৌদ্ধবিহার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় চার বছর পালন করেছি শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব। এ সময় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ইউসুফ সাহেব (এম. ইউসুফ আলী)। তিনি দিনাজপুরের মানুষ। সীতাকোট বিহার খননের কাজটি পূর্ণতা পেল তাঁর সহযোগিতায়।
দুর্গাকারে নির্মিত প্রায় বর্গাকৃতির এ বিহারটি পূর্ব-পশ্চিমে ২১৪ ফুট ও উত্তর-দক্ষিণে ২১২ ফুট লম্বা। উত্তর বাহুর ঠিক মাঝখানে বিহারের মূল ফটক। পুরো বিহারে ছোট-বড় কক্ষ ৪১টি। প্রতিটি কক্ষের মেঝে সুরকির মসলা দিয়ে শক্তভাবে পাকা করা। কক্ষগুলোতে কোনো জানালা নেই, কিন্তু আছে ভেন্টিলেটর বা বায়ুপথ। এ বিহারটি দুই পর্যায়ে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং একপর্যায়ে এর মেরামত কাজ হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, পঞ্চম শতাব্দীর কিছু পরে নির্মিত হয় বিহারটি। পরে কোনো কারণে এই সীতাকোট বিহারটি পরিত্যক্ত হয়। ফলে এ বিহারে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রত্ননিদর্শন পাওয়া যায়নি। বহু অর্থব্যয়ে ও বেশ শক্তভাবে নির্মিত হলেও এ বিহারের শিল্প ও অলংকরণে তেমন কোনো নান্দনিক ছাপ পরিলক্ষিত হয় না।
যা হোক, ১৯৪৬-এর সেই মহাস্থানগড় ভ্রমণ আমার জীবনে একটি মাইলফলক। এই ভ্রমণের প্রভাবেই তো একদা আমি দেখতে গিয়েছি ইউরোপের প্রাচীন নিদর্শন। আর ১৯৫৮-এ সীতাকোট বিহার আবিষ্কার ও পরবর্তীকালের খননকাজ প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আমাকে আগ্রহী করে তুলেছে পুরোপুরি। ’৪৬ থেকে অদ্যাবধি মেতে আছি প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে। সরকারের প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়েও আমি পরিচিতি পেয়েছি প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে। যদিও জীবনের সায়াহ্নে এসে আজ মনে হয়, আমি এখনো প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের ছাত্রই থেকে গেছি!
অনুলিখন: মুহাম্মদ লুৎফুল হক